আস্থা যখন টেলিমেডিসিনে

সোনিয়া আক্তারের বয়স ৩১ বছর। রংপুর জেলা সদরে একটি কলেজে শিক্ষকতা করছেন। দুদিন ধরে কয়েক দফায় বেড়েছে শরীরের তাপমাত্রা। ১০২ ডিগ্রি জ্বরের সঙ্গে হালকা কাশি, শরীর ব্যথা ও মাথাব্যথা। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য নিয়ে বেশ চিন্তিত সোনিয়া। ঘর থেকে বেরিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার শক্তিটুকু নেই। শরীরে ডেঙ্গুর লক্ষণ থাকায় তাঁর ধারণা, তিনিও ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত। কীভাবে দ্রুত চিকিৎসা নেবেন, তা নিয়ে ভাবনার শেষ নেই সোনিয়ার।

এমন পরিস্থিতি দেখে টেলিমেডিসিনের পরামর্শ নিতে বলেন সহকর্মী রোকসানা। মুঠোফোনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে যাবতীয় সমস্যার কথা জানালে তিনি প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন। নিয়মিত ডাক্তারদের পরামর্শ ও ফলোআপ চিকিৎসা নিয়ে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেন সোনিয়া। ঘরে বসে এ ধরনের সেবা পেয়ে টেলিমেডিসিনের ওপর তার আস্থা তৈরি হয়েছে।

অন্যদিকে পঞ্চাশোর্ধ্ব রাবেয়া বেগম দুই মেয়ে নিয়ে টাঙ্গাইলে থাকেন। দুই বছর আগে স্বামী মারা গেছেন। কয়েকদিন ধরে অসুস্থতা অনুভব করছেন। বাড়ির পাশের ফার্মেসিতে গিয়ে ফার্মাসিস্ট দেখালে তিনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে বলেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাতে হলে জেলা শহরে যেতে হবে। যাতায়াত, ডাক্তারের পরামর্শ ফি ও ওষুধ কিনতে অনেক টাকা লাগবে, যা রাবেয়ার সামর্থ্যরে বাইরে। এদিকে মায়ের চিকিৎসা নিয়ে বেশ চিন্তিত রাবেয়ার কলেজ পড়ুয়া মেয়ে তানহা। বিষয়টি তার বান্ধবীকে জানালে টেলিমেডিসিন সেবা নেওয়ার পরামর্শ দেয়।

পরামর্শ অনুযায়ী সরকারি হেল্পলাইন ‘৩৩৩’ নম্বরে কল দেয় তানহা। প্রথম কলেই হটলাইনে একজন মহিলা ডাক্তারের সঙ্গে সংযোগ পেলেন। তার মায়ের শারীরিক অবস্থা বর্ণনা করলে ডাক্তার শুনেন এবং কিছু প্রশ্ন করেন। এরপর কয়েকটি ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেন ডাক্তার। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন ও অন্যান্য নিয়ম মেনে ছয়দিনেই সুস্থ হয়ে উঠেন রাবেয়া বেগম। সুস্থ হওয়ায় পর তার প্রতিবেশীদের টেলিমেডিসিন সেবার সুফল সম্পর্কে বলেন।
সোনিয়া ও রাবেয়ার মতো প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার মানুষকে ঘরে বসে টেলিমেডিসিন সেবা গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে বর্তমান সরকার। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।

টেলিমেডিসিন কী?
টেলিমেডিসিন বলতে বুঝায় কোনো ভৌগোলিক দূরত্বে অবস্থানরত রোগীকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সাহায্যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, বিশেষায়িত নেটওয়ার্ক, রোগ নির্ণয় কেন্দ্র প্রভৃতির সমন্বয়ে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়াকে। টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের রোগীরা ঘরে বসে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চিকিৎসাসংক্রান্ত পরামর্শ নিতে পারেন। চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা যায় টেলিফোন, মোবাইল ফোন, ভিডিও কনফারেন্স বা অনলাইনের বিভিন্ন কলিং সফটওয়্যার যেমন- হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমো প্রভৃতি।

বাংলাদেশে টেলিমেডিসিন সেবা
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও মুঠোফোন চিকিৎসা সেবা বা টেলিমেডিসিন সেবা চালু হয়েছে। ১৯৯৯ সালে দাতব্য সংস্থার হাত ধরে দেশে টেলিমেডিসিনের কার্যক্রম শুরু হয়। তখন ক্যামেরা ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় ছবি তুলে ইমেইলের মাধ্যমে কনসালট্যান্টের কাছে পাঠানো হতো। এরপর থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নানাভাবে টেলিমেডিসিন সেবা চলমান রাখে। যদিও বাংলাদেশের মানুষ এ সেবার সঙ্গে ওইভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেনি। মুঠোফোন সহজলভ্য হওয়ার পর থেকে মানুষ রোগব্যাধিতে পরামর্শ পাওয়ার পাশাপাশি খুদে বার্তায় ব্যবস্থাপত্র পেতে শুরু করেন।

এদিকে করোনাকালে মানুষের প্রধান সহায় হয়ে উঠেছিল টেলিমেডিসিন। করোনা মহামারির সময় চিকিৎসক ও রোগীর মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সংক্রমণ ভীতি। হাসপাতাল বা চিকিৎসকের চেম্বারে ঝুঁকি বেশি, এই বিবেচনায় রোগীরা এসব স্থান এড়িয়ে চলতেন। তাছাড়া অনেক ডাক্তার সরাসরি রোগী দেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন সেসময়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহামারির সময় চিকিৎসার সেরা বিকল্প টেলিমেডিসিন। করোনা রোগী হাসপাতালের চেয়ে বেশি সেবা পেয়েছেন এই বিকল্প পন্থায়। করোনা ছড়িয়ে পড়া রোধে এটি একটি সফল মাধ্যম। একই সঙ্গে এটি শুধু বর্তমানেই নয়, ভবিষ্যতেও এর চাহিদা আরও বৃদ্ধি পাবে।

টেলিমেডিসিন সেবায় সরকারের যত উদ্যোগ
ডিজিটাল বাংলাদেশে নাগরিকের আধুনিক চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। সহজলভ্য ও দূরবর্তী চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে সরকার টেলিমেডিসিন সেবা চালু করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সরকারি হেলথ কল সেন্টার স্বাস্থ্য বাতায়ন ‘১৬২৬৩’ এবং আইসিটি মন্ত্রণালয়ের এটুআই প্রোগ্রাম দ্বারা পরিচালিত জাতীয় হেল্পলাইন ‘৩৩৩’।

সরকারি হেলথ কল সেন্টার স্বাস্থ্য বাতায়ন ‘১৬২৬৩’
২০১৬ সালে সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় চালু করে ‘সরকারি হেলথ কল সেন্টার স্বাস্থ্য বাতায়ন’। এ সেবা পেতে ‘১৬২৬৩’ নম্বরে ডায়াল করলেই ২৪ ঘণ্টা বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবার পরামর্শ পাওয়া যাচ্ছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এছাড়া স্বাস্থ্য বাতায়ন দেশের যে কোনো স্থানের রোগীদের প্রয়োজনে নিকটবর্তী সরকারি-বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স সেবা পেতেও সহায়তা করছে।

২০২০ সালে করোনার কারণে যখন স্বাস্থ্য অবকাঠামো ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল, তখন মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য বাতায়ন ১৬২৬৩ একটি অভিনব সেবা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। অন্যান্য সেবা যখন মিলছিল না, তখনও অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা পরামর্শ দেওয়ার সবচেয়ে বড়ো প্ল্যাটফরম স্বাস্থ্য বাতায়ন সব সময় খোলা ছিল। সেবাগ্রহীতাদের মধ্যে যাদের কোভিড-১৯ সংক্রমণ ধরা পড়েছে, পরবর্তী সময়ে হেল্পলাইন থেকে কল করেও তাদের খোঁজখবর নেওয়া হয়, পরামর্শ সেবা দেওয়া হয়। এ হেল্পলাইনে এ পর্যন্ত প্রায় ৩ কোটি ৯৭ লাখ মানুষকে মুঠোফোনে সেবা দিয়েছে সরকার।

জাতীয় হেল্পলাইন ‘৩৩৩’
২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি মন্ত্রণালয়ের এটুআই প্রোগ্রাম দ্বারা চালু হয় জাতীয় হেল্পলাইন ‘৩৩৩’, যা ‘জাতীয় হেল্পলাইন’ নামেও পরিচিত। এর মূল লক্ষ্য বাংলাদেশের নাগরিক যেন জাতীয় তথ্য বাতায়নের সব তথ্য ও সেবা পেতে পারেন। দেশের নাগরিকরা ৩৩৩ নম্বরে কল করে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সেবা পেতে ১ চেপে মেন্যুতে প্রবেশ করে ঘরে বসেই নিরাপদে অভিজ্ঞ ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে পারছেন। শুধু তালিকাভুক্ত চিকিৎসকরাই এখানে ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসা পরামর্শ দিয়ে থাকেন। করোনাকালে হেল্পলাইনে ফোনের সংখ্যা অনেক বেড়েছে বলে আইসিটি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।

এছাড়া ৩৩৩ নম্বরের মাধ্যমে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ মাঠ পর্যায়ের সব কর্মকর্তার কাছে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সমাধান ও নাগরিক সেবা প্রাপ্তির বিষয়ে অনুরোধ করতে পারেন। এই সেবা চালু হওয়ার পর থেকে ৭ কোটি ৬০ লাখেরও অধিক কল গৃহীত হয়েছে, যার মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় ২৬ হাজারের অধিক সামাজিক সমস্যার সমাধান করা হয়েছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হটলাইন ১০৬৫৬
২০১৪ সাল থেকে টেলিমেডিসিন সেবা দিয়ে আসছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ২০ থেকে ২৫টি উপজেলা তাদের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে, যারা নিয়মিত অনলাইনে সেবা নিচ্ছেন। কবে কোন ডাক্তার থাকবেন, সেসব তাদের জানা আছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় ২০২০ সালে টেলিমেডিসিনের হটলাইন ‘১০৬৫৬‘ সেবা চালু করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। নম্বরটিতে ২৪ ঘণ্টা টেলিমেডিসিন সেবা পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া প্রতিটি বিভাগে আলাদা নম্বরে কল করে রোগীরা সেবা নিতে পারবেন। নম্বরগুলো হচ্ছে: মেডিসিন বিভাগ ০১৭৯৭১৭০১৩৯, ০১৭৯৭১৭০৮৬৫; সার্জারি বিভাগ ০১৭৯৭১৭৮৪৩৫; গাইনি বিভাগ ০১৭৯৭১৭১০১৮; শিশু বিভাগ ০১৭৯৭১৭০২৯৪; জরুরি বিভাগ ০১৭৯৭১৭০৩৫৮; কার্ডিওলজি বিভাগ ০১৭৯৭১৭৪৮১৭ এবং প্রশাসন বিভাগ ০১৭৯৭১৭১৩৫৬।

এছাড়া সরকারি সব হাসপাতাল, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতাল থেকে টেলিমিডিসিন সেবা দেওয়া হচ্ছে। যার ফলে সমগ্র জনগোষ্ঠীর একটি বড়ো অংশ ঘরে বসেই সঠিক স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের মাধ্যমে স্বাস্থ্য পরামর্শ পাচ্ছেন।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে টেলিমেডিসিনের প্রচলন বাংলাদেশের জন্য নতুন ও আধুনিক একটি ধারণা। প্রযুক্তি ব্যবহার করে অসুস্থ রোগীরা এখন গ্রামে বসেই রাজধানীর বড়ো বড়ো ডাক্তারদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে পারছেন। হাজার হাজার টাকা খরচ করে গ্রাম থেকে ঢাকায় আসতে হচ্ছে না। প্রয়োজনে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে চিকিৎসকের সঙ্গে রোগী কথা বলতে পারছেন, সমস্যাগুলো দেখাতেও পারছেন। পুরনো রোগীরা তাদের প্রেসক্রিপশন হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবারে পাঠিয়ে দিয়ে বিশেষজ্ঞের নতুন পরামর্শও নিতে পারছেন, পুরো বিষয়টি আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) সূত্রে জানা যায়, দেশে টেলিমেডিসিনের বাজার প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার। প্রতিদিন ২০ হাজারের বেশি রোগী টেলিমেডিসিন সেবা নিচ্ছেন। দেশের এই বিশাল জনগোষ্ঠীর টেলিমেডিসিন সেবায় অভ্যস্ত হতে হয়তো আরও কয়েক বছর লেগে যাবে। তবে এটা নিশ্চিন্তে বলা যায়, টেলিমেডিসিন সেবা খুব শীঘ্রই স্বাস্থ্যসেবার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠবে।

লেখক: সাংবাদিক ও ই-লার্নিং ম্যানেজার, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)

সর্বশেষ নিবন্ধ

ফেসবুকে সারথি

শেয়ার করুন