‘ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা: দ্যা সুপার সোলজার’

“I could do this all day” বলতে বলতে হাতের শিল্ড নিয়ে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়া ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকার নাম শোনেনি এমন কমিক্স লাভার আছে বলে আমার মনে হয় না। বিশেষ করে মার্বেল সিনেম্যাটিক্স ইউনিভার্সের সবচেয়ে সফল সিনেমা ‘অ্যাভেঞ্জারস এন্ড গেম’ রিলিজ হওয়ার পর তো নয়ই। থেনোসের পুরো আর্মির বিরুদ্ধে ক্যাপ্টেন তার ভাঙ্গা শিল্ড নিয়ে একা দাঁড়িয়ে থাকার সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্য মন ছুঁয়েছে কোটি কোটি ভক্তের। আবার একই সিনেমায় থরের হ্যামার তুলে নেয়ার সেই এপিক দৃশ্যে উল্লাসে ফেঁটে পড়তেও ভুলে যাননি সিনেমাহলভর্তি উত্তেজিত দর্শক। আজকের এই লেখা সেই মানুষটাকে নিয়ে। আমাদের প্রিয় ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা।

মার্বেল কমিক্সের মধ্যে আমার প্রিয় চরিত্রের একটি ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা। যখন একটি দল সবদিক থেকে পুরোপুরি বিধ্বস্ত, যখন বিপরীতপক্ষের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়ানো দায়, তখন পরিস্থিতি সামলে নিয়ে ঠান্ডা মাথায় দলকে জয়ের দিকে নিয়ে যায় একজন। ফুটবলের উদাহরণ দিলে সেখানে উঠে আসে মেসি-রোনালদোর নাম; বাংলাদেশ ক্রিকেটের কথা বললে একনাম প্রিয় ম্যাশ; ঠিক সেরকম অ্যাভেঞ্জারসের কথা বললে ঠোঁটের আগায় চলে আসে ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকার নাম।

 পর্দায় যখন ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকার সিনেমা দেখতে বসি তখন মানুষটার প্রতি একধরনের ভালোবাসা কাজ করে আমার। কারণ জন্মগত প্রতিভায় ঠাসা কমিক্স সুপারহিরোদের রাজ্যে ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা আমারই মতো জন্ম প্রতিভাহীন একজন সাধারণ মানুষ। সাফল্যের ক্ষুধা, বড় যুদ্ধে নার্ভ ধরে রাখা, সামনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দেয়া, শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়া, প্রতিটি পরিস্থিতি থেকে নতুন কিছু শেখা, হেরে যাওয়ার আগে হেরে না যাওয়া আর দাপটের সাথে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে থাকা এই মানুষটার ভেতর আমি নিজেকে দেখি। ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকাকে টক্কর দেয়ার মতো আরও হাজারটা কমিক চরিত্র কমিক্স ওয়ার্ল্ডে থাকতে পারে। কিন্তু মন ছুঁয়ে গেছে এই এক ক্যাপ্টেন। আজ এই লেখায় ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা সৃষ্টির ইতিহাস তুলে ধরব।

ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা চরিত্রটি সৃষ্টি করা হয়েছে ১৯৪০ সালে। অনেকের ধারণা মার্বেল কমিক্স হিরোদের স্রষ্টা স্ট্যান লী ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকাকে বানায়। কিন্তু সেটি আসলে ভুল। কার্টুনিস্ট জো সাইমন এবং জ্যাক কিরবী ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকাকে তৈরী করেন। আর মার্বেল কমিক্স ১৯৪১ সালে “ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা ভল্যুম ১” কমিক্সে সর্বপ্রথম ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকাকে প্রকাশ করে।

ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা চরিত্রটি যখন সৃষ্টি করা হয় তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। হিটলারের নাৎসি বাহিনী পুরো পৃথিবীতে পাশবিক ধ্বংস লীলা চালাচ্ছিল। তারা ধৈর্যের সকল সীমা পার করে ফেলেছিল। ঠিক তখন নাৎসি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ থামানোর জন্য অ্যামেরিকাও এই যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে নেমে পড়ে। নাৎসি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ জোস সাইমন আর জ্যাক কিরবীর মনেও গভীর দাগ কাটে। বর্তমান সময়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য লেখকরা যেমন নানান বিদ্রোহীধর্মী লেখালেখি করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ করতে গিয়ে জোস সাইমন এবং জ্যাক কিরবী ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা চরিত্রটি সৃষ্টি করে ফেলেন। আর ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকাকে প্রকাশ করা হয় ওয়ার হিরো হিসেবে। যার কাজ হচ্ছে, আর্মিতে যোগদান করে দেশসেবা করা। নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকার প্রথম কমিক্স বইটির প্রচ্ছদে ক্যাপ্টেন হিটলারের মুখে ঘুষি মারার একটি দৃশ্য আঁকা থাকে। যা দেখে জার্মানরা ক্ষ্যাপে যায়।

জোস সাইমনের মাথায় যখন ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা চরিত্রটির পরিকল্পনা আসে তখন তিনি ভেবেছিলেন এটিকে “সুপার অ্যামেরিকা” নাম দিয়ে প্রকাশ করবেন। কিন্তু সেসময় সুপার নাম দিয়ে বিভিন্ন কমিক ক্যারেক্টর ছিলো। তাই সুপার অ্যামেরিকা নাম না রেখে, ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা নাম রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

মার্বেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স ২০১২ সালে তৈরি করে “ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা: দ্য ফার্স্ট অ্যাভেঞ্জার” চলচ্চিত্র তৈরী করার মাধ্যমে ক্যাপ্টেনের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। চলচিত্রটিতে স্টিভ রজার্স নামক এক ব্যক্তি পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা হয়।

স্টিভ রজার্সের বাবা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে শহীদ হয়। তাই তারও ইচ্ছে হয় আর্মিতে ভর্তি হওয়ার। কিন্তু শারীরিক ভাবে অত্যন্ত দূর্বল হওয়ার কারণে স্টিভ বার বার বাদ পড়ে যায়। কিন্তু সে হার মানে না। বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ঠিকই লেগে থাকে ইউএস আর্মির সাথে। একদিন ইউএস আর্মি সিদ্ধান্ত নেয় তারা একজন সুপার সোলজার তৈরী করবে। যে যুদ্ধক্ষেত্রে বাকিদের তুলনায় বেশি শক্তিশালী, বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারবে। সেই সুপার সোলজারের জন্য স্টিভ রজার্সকে বেছে নেয়া হয়। কারণ সুপার সোলজার বানাতে গেলে মানবদেহে যে ‘সুপার সোলজার’ সিরাম প্রবেশ করানো হবে তার জন্য স্টিভ রজার্সের শারীরিক কাঠামো ছিলো যথোপযুক্ত। স্টিভ রজার্সকে ল্যাবে নিয়ে গিয়ে এক্সপেরিমেন্ট হিসেবে সেই সিরাম তার দেহে প্রবেশ করানো হয়। এতে কয়েক মিনিটের মাথায় দেখতে পাওয়া যায় হারকিউলাসের মতো এক বডিবিল্ডার। অর্থাৎ সুপার সোলজার। এই সুপার সোলজারই পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা হিসেবে নিজের আত্মপ্রকাশ ঘটায়। ঝাঁপিয়ে পড়ে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে।

ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকার গায়ের লাল-নীল পোশাকটি বুলেটপ্রুফ। ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকার প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে তার হাতের গোল শিল্ড। এটি সে প্রতিরক্ষার জন্য ব্যবহার করে। মাঝে মাঝে অস্ত্র হিসেবে ছুঁড়ে মারতেও দেখা যায়। শিল্ডটি তৈরি করা হয় ভাইব্রেনিয়াম দিয়ে। ভাইব্রেনিয়াম এমন একটি ধাতু যা সহজে ভাঙ্গে না। বোমা-বারুদ যা-ই আসুক না কেনো এই শিল্ড দিয়ে সেসব আটকে দেয়া যাবে। যদিও থেনোসের মরণঘাতী ব্লেডের একের পর এক কোপের সামনে একসময় শিল্ডটি ভেঙ্গে যায়।

এ পর্যায়ে ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকার সক্ষমতা নিয়ে আলোচনা করা যাক। দেহে সুপার সোলজার সিরাম প্রবেশের পর স্টিভ রজার্সের ব্যাপক স্বাস্থ্য উন্নতি হয়। পাশাপাশি তার সক্ষমতা বেড়ে যায়। শারীরিক সক্ষমতা বেড়ে যাওয়ার দরুন ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা অনেকক্ষণ যাবত যুদ্ধময়দানে টিকে থাকতে পারে, শত প্রহার সহ্য করতে পারে। একজন স্বাভাবিক মানুষের দৌঁড়ানোর গড় স্পীড যেখানে ঘণ্টায় ১০-১২ কিলোমিটার, সেখানে ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকার দৌঁড়ানোর গড় স্পীড ঘণ্টায় প্রায় ৪৬ কিলোমিটার। দৌঁড়ানো আর শারীরিক সক্ষমতা ছাড়াও ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকার আরেকটি সক্ষমতা হচ্ছে সে অল্প সময়ের ভেতর যেকোনো হাতিয়ার চালানো শিখে ফেলতে জানে। যা আমরা দেখতে পাই অ্যাভেঞ্জারস এন্ড গেমে থরের হাতুড়ে চালানোর ঘটনাটিতে।

সুপার সিরামের কারণে ক্যাপ্টেন কখনো অসুস্থ হয় না। সুপার সিরাম ক্যাপ্টেনের শরীরে নিজে নিজে গঠিত হতে থাকে। আর এটি ততদিন হতে থাকবে যতদিন না ক্যাপ্টেন মারা যায়।

“ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা: দ্যা ফার্স্ট অ্যাভেঞ্জার” চলচিত্রে ক্যাপ্টেন রেডস্কালের সাথে লড়াই করার সময় একটি বিমান দুর্ঘটনায় জ্ঞান হারায়। আর জ্ঞান ফিরে ৭০ বছর পর। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে “ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা: উইন্টার সোলজার” চলচিত্রে হাইড্রা আর শিল্ডের মধ্যকার স্নায়ুবিক যুদ্ধ নিয়ে গল্প দাঁড় করানো হয়। যেখানে ক্যাপ্টেনের বন্ধু বাক্কিকে হাইড্রার লোকজন মন্দ কাজে ব্যবহার করে। ২০১৬ সালে এসে ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকার উপর আরেকটি চলচিত্র নির্মাণ করা হয় “ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা: সিভিল ওয়ার”। এই চলচিত্রে ক্যাপ্টেনের মুখোমুখি হতে দেখা যায় আয়রন ম্যানের সাথে। সোকোভিয়া চুক্তিতে স্বাক্ষর করা নিয়ে দাঁড় করানো হয় এই চলচিত্রের গল্প। আয়রন ম্যান সোকোভিয়া চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে রাজি হলেও, ক্যাপ্টেন রাজি হয় না। তারপর ক্যাপ্টেনের বন্ধু বাক্কিকে গ্রেফতার করা নিয়ে আয়রন ম্যান আর ক্যাপ্টেনের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা হিসেবে স্টিভ রজার্সের অবসান ঘটানো হয় ২০১৯ সালের “অ্যাভেঞ্জারস এন্ড গেম” চলচিত্রে। অর্থাৎ মার্বেলের চলচিত্র জগতে নতুন কাউকে আবার ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা চরিত্রে দেখা যাবে। আর সেটা হতে পারে ফ্যালকন বা অন্য কেউ।

ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা অ্যাভেঞ্জারস টিমের ক্যাপ্টেন। যতবার পৃথিবীতে খারাপ শক্তির আগমন ঘটেছে ক্যাপ্টেন ততবার সেই অপশক্তির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সঙ্গ দিয়েছে নিজের সঙ্গীদের। বুদ্ধিমত্তা আর যেতার অদম্য ইচ্ছা থেকে ক্যাপ্টেন প্রতিবারই জয় লাভ করে। প্রতিপক্ষ হিসেবে হোক সেটা মানুষ অথবা ভয়াবহ কোনো এলিয়েন। আমরা যারা  “অ্যাভেঞ্জারস এন্ড গেম” দেখেছি, তারা জানি স্টিভ রজার্সকে ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা হিসেবে মার্বেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সে আর কখনোই দেখা যাবে না। সে অবসর নিয়েছে তার দায়িত্ব থেকে। কিন্তু তার অসাধারণ কার্যকলাপ অনুপ্রেরণা হিসেবে থেকে যাবে সকল কমিক্স প্রেমিদের মনে।

সর্বশেষ নিবন্ধ

ফেসবুকে সারথি

শেয়ার করুন