গেম অব থ্রোনস: থ্রোনের সূত্রপাত ও সমাপ্তি বিশ্লেষণ

গেম অব থ্রোনস  এইচভিও চ্যানেলে প্রচারিত পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি টিভি সিরিজ। টিভি সিরিজের নাম শুনলে, পরিবারের সাথে বসে জি বাংলার সেই একঘেয়ে বস্তাপঁচা সিরিয়াল দেখার কথা মনে পড়া স্বাভাবিক। কিন্তু জটিল পলিটিক্স, পাশবিক হত্যাযজ্ঞ আর ফাঁকে ফাঁকে হালকা এডাল্ট দৃশ্যের জন্য গেম অব থ্রোনস তার দর্শকদের পরিবারের সাথে বসে দেখার সেই সুযোগ দিবে না। এই সিরিজ দেখতে হলে দরকার ছিলো নিজের একটি ব্যক্তিগত টেলিভিশন। অথবা টরেন্ট ওয়েবসাইট তো আছেই। গবেষণা থেকে জানা গেছে, গেম অব থ্রোনস হলো ইন্টারনেট দুনিয়ার একমাত্র জিনিস যা ইতিহাসের সবচেয়ে বেশিবার পাইরেটেড ভাবে ডাউনলোড করা হয়েছে! মধ্যযুগীয় পলিটিক্স, দাবা খেলার মতো রাজ্য জয়ের সূক্ষ্মচাল আর অতিপ্রাকৃত বিষয়ে ঠাঁসা এই ‘গেম অব থ্রোনস’ সিরিজটি টেলিভিশন সিরিজের জগতে অধিপতি হয়ে আছে।

সিরিজের প্রথম সিজনের প্রথম এপিসোডের ১৫ মিনিটের মাথায় “Winter is coming” বলতে বলতে হাজার হাজার হোয়াইট ওয়াকার্সের হেঁটে আসার দৃশ্য দেখার পর, খুব কম দর্শক আছে যারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো এই সিরিজের মোহে পড়েনি। নাইট ওয়াকার্স হচ্ছে এই গল্পের প্রধান খলনায়ক। এরা বরফে ঢাকা একধরনের ভূত। এরা যাদের ছুঁয়ে দেয় তারাও হোয়াইট ওয়াকার হয়ে যায় এবং তাদের ভূতবাহিনীতে যোগদান করে। হোয়াইট ওয়াকার্সকে হত্যা করা যায় না। সিরিজে দেখা যায় এরা একধ্যানে সেভেন কিংডমস এর দিকে এগোতে থাকে। হোয়াইট ওয়াকার্সের সবার মুখে একটাই স্লোগান “Winter is coming”. সেভেন কিংডমসে শীত নামার সাথে সাথে হামলা করবে তারা। শীতকাল বা বরফ ছাড়া এরা সাধারণত চলাফেরা করে না।

গেম অব থ্রোনসের গল্প তিনটি স্থানকে ঘিরে সাজানো হয়েছে। ওয়েস্টেরোস, এসোস আর দ্যা ওয়াল। অনেক বছর আগে এসোসে বাস করতো টার্গেরিয়ান পরিবার। তারা ড্রাগন পুষতো। একসময় টার্গেরিয়ান পরিবার ওয়েস্টেরোসে নিজেদের স্থানান্তর করে। আর সেখানে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করতে থাকে। আধিপত্য প্রতিষ্ঠার একপর্যায়ে টার্গেরিয়ান পরিবারের প্রধান অ্যাগোন, ওয়েস্টেরোসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন রাজ্যকে একত্রিত করে সেভেন কিংডমস প্রতিষ্ঠা করে। সেভেন কিংডমসের রাজ্যগুলো হচ্ছে- দ্যা নর্থ, দ্যা ভ্যাল, দ্যা রিভারল্যান্ডস, ওয়েস্টারল্যান্ড, দ্যা রীচ, স্টোর্মল্যান্ডস ও ডর্ন। আর এই সাতটি রাজ্যের দায়িত্ব থাকে সাতটি অভিজাত পরিবারের হাতে। অ্যাগোন যুদ্ধে পাওয়া শত্রুদের তলোয়ার, হাতিয়ার দিয়ে একটি সিংহাসন তৈরী করে। যার নাম দেয় “আয়রন থ্রোন”। আর এই আয়রন থ্রোন বা লৌহ সিংহাসনের ক্ষমতা দখল নিয়েই সাত রাজ্যের সাত পরিবারের মধ্যে যাবতীয় রাজনীতি, হত্যাযজ্ঞ, ষড়যন্ত্রের খেলা চলতে থাকে। অ্যাগোন সেভেন কিংডমসের মূল কেন্দ্রবিন্দু বা রাজধানী হিসেবে “কিংস ল্যান্ডিং” প্রতিষ্ঠা করে। গেম অব থ্রোনস টিভি সিরিজে দেখা যায়, কিংস ল্যান্ডিংয়ের ক্ষমতায় থাকে ল্যানিস্টার পরিবার। যারা প্রচন্ড ধূর্ত প্রকৃতির।

গেম অব থ্রোনসের শুরুর দিকের ঘটনা থেকে বোঝা যায়, টার্গেরিয়ান নেতা ম্যাড কিং এর মৃত্যুর পর স্টোর্মল্যান্ডস রাজ্যের প্রধান রবার্ট বেরাথিয়ন সেভেন কিংডমসের রাজা হয়। সিরিজের সিজন সেভেনে গিয়ে রবার্ট বেরাথিয়নের রাজা হওয়া সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পাওয়া যায়। রবার্ট বেরাথিয়নের রাজা হওয়ার মধ্য দিয়েই সিংহাসন নিয়ে খেলার মূল কাহিনী শুরু হয়।

রবার্ট বেরাথিয়ন রাজা হওয়ার পর ম্যাড কিং এর বংশধর ডিনারিয়াস টার্গেরিয়ান ও তার ভাইকে নির্বাসনে এসোস পাঠিয়ে দেয়। তখন ডিনারিয়াস সেভেন কিংডমসে নিজের ক্ষমতা জাহির করার জন্য নিজেকে সেখানে তৈরী করতে থাকে। এই ডিনারিয়াস গল্পে ‘ড্রাগন কুইন’ নামে পরিচিত।

ওদিকে গল্পে দ্যা ওয়াল স্থানটি একটি রহস্যময় জায়গা। এটি একটি ৭০০ ফিট উঁচু দেয়াল। যেটি সেভেন কিংডমসকে বাইরের পরাশক্তি থেকে রক্ষা করে। দেয়ালের ওপারে থাকে হোয়াইট ওয়াকার্স আর বন্য সম্প্রদায়ের মানুষ। দ্যা ওয়ালে যারা দায়িত্বরত থাকে তাদের বলে, নাইট ওয়াচ। গল্পের অন্যতম প্রধান চরিত্র জন স্নো নাইট ওয়াচদের একজন।

গেম অব থ্রোনসের কাহিনী সেভেন কিংডমস, এসোস আর দ্যা ওয়াল ঘিরেই চলতে থাকে। আট সিজনের এই টিভি সিরিজটি ৭৩ এপিসোডের। প্রতিটি সিরিজ ধরে ধরে বোঝার জন্য দেখতে হবে এই অসাধারণ টিভি সিরিজটি। অথবা পড়তে হবে জর্জ আর. আর. মার্টিনের “অ্যা সং অব আইস অ্যান্ড ফায়ার” উপন্যাস সিরিজ। ডেভিড ভেনিওফ ও ডি.বি. ওয়েস এই উপন্যাসটিকে কেন্দ্র করে বানায় আমাদের প্রিয় গেম অব থ্রোনস।

মার্টিন সাহেবের উপন্যাসে চরিত্র সংখ্যা দুই হাজারের বেশি হলেও, টিভি সিরিজে দেড়শোর মতো দেখানো হয়েছে। যার মধ্যে প্রধান কয়েকটি চরিত্র হচ্ছে, স্টার্ক পরিবারের নেড স্টার্ক, ক্যাটলিন স্টার্ক ও তাদের পাঁচ সন্তান। রাজধানী কিংস ল্যান্ডিংয়ে রয়েছে রাজা রবার্ট বেরাথিয়ন, রাণী সার্সি ল্যানিস্টার, জ্যামি ল্যানিস্টার এবং দ্যা গ্রেট টিরিয়ন ল্যানিস্টার। শেষ পর্যন্ত এমন আরও অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র দেখা যায় সিরিজটিতে।

জর্জ আর. আর. মার্টিন তার উপন্যাস “আ সং অব আইস অ্যান্ড ফায়ার” সাজিয়েছেন মধ্যযুগীয় সময়ের প্রেক্ষাপটে। এখানে নানান অতিপ্রাকৃত ঘটনা ঘটে। এখানে মানুষ আর ইশ্বরের মাঝে সরাসরি সম্পর্ক দেখা যায়। মানুষ ইশ্বরের পুজো করছে আর ইশ্বরও তাদের ডাকে সরাসরি সাড়া দিচ্ছে। মানুষ মৃত্যুর পর ইশ্বরের মাধ্যমে জীবিত হয়ে উঠছে। প্রাচীন মিথের ড্রাগনের অস্তিত্বও এখানে দেখা যায়। তাছাড়া হোয়াট ওয়াকার্সের মতো ভূতেরদল তো আছেই

এই সিরিজে রক্তারক্তির ঘটনা প্রচন্ড খারাপ ভাবে দেখানো হয়েছে। বাচ্চা, বুড়ো, মহিলা সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করতে দেখা যায়। রক্তারক্তি এবং এডাল্ট দৃশ্যের জন্য এই সিরিজটি ১৬ বছরের নিচে কারোর জন্য নয়।

এই সিরিজ দেখলে ধারণা পাওয়া যাবে রাজনীতি সম্বন্ধে। মধ্যযুগীয় রাজারা সিংহাসন দখলের জন্য কতটা কূটনীতি আর নির্মমতার আশ্রয় নিতো তা দেখা যায় এখানে। তাছাড়া রাজা আর প্রজার মাঝের চরিত্রগুলো একটি ইতিহাস পরিবর্তনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সে সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায় গেম অব থ্রোনসে।

গেম অব থ্রোনস টিভি সিরিজটি শুরু হয় ২০১১ সালে এবং শেষ করে দেয়া হয় ২০১৯ সালে। গেম অব থ্রোনসের গল্প শুরু হয় আয়রন থ্রোন প্রতিষ্ঠার পর থেকে। আর শেষ করে দেয়া হয় আয়রন থ্রোন ধ্বংস করে দিয়ে। জন স্নো ডিনারিয়াসকে হত্যা করলে তার ড্রাগন এসে আয়রন থ্রোন জ্বালিয়ে দেয়। তারপর ডিনারিয়াসের লাশ নিয়ে উড়ে চলে যায়। পুরো সিরিজ জুড়ে হোয়াইট ওয়াকারদের আগমন নিয়ে একটা গা ছমছমে উত্তেজনা থাকে। অথচ তাদের সমাপ্তি ঘটে খুবই সহজ ভাবে। টিরিয়ান ল্যানিস্টারের পরামর্শে ব্রেন স্টার্ককে সেভেন কিংডমসের ছয়টি রাজ্যের দায়িত্ব দিয়ে নতুন রাজা ঘোষণা করা হয়। আর এভাবেই সমাপ্তি ঘটে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি টাকা আয় করা আট সিজনের টিভি সিরিজ গেম অব থ্রোনস এর।

টিভি সিরিজ হিসেবে যদিও গেম অব থ্রোনসের সমাপ্তি ঘটে, কিন্তু এর মূল স্রষ্টা জর্জ আর. আর. মার্টিনের মতে এখনও শেষ হয়নি। “আ সং অব আইস অ্যান্ড ফায়ার” এর শেষ সিরিজ এখনো বের করা হয়নি। গেম অব থ্রোনস টিভি সিরিজের সমাপ্তি ভক্তদের মনমতো না হলেও, বুক সিরিজে লেখক একটি চমৎকার সমাপ্তি দিবেন এমনটা আশা করছে ভক্তবৃন্দ।

সর্বশেষ নিবন্ধ

ফেসবুকে সারথি

শেয়ার করুন