লিওনেল মেসি: কিংবদন্তি হয়ে ওঠার গল্প

ফুটবল -নান্দনিকতার ও ছন্দের সংমিশ্রণে অসাধারণ এক শিল্প শৈলীর খেলা যজ্ঞ। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এ খেলাকে সকারও (Soccer) বলা হয়ে থাকে অঞ্চলভেদে। ফুটবল বিশ্বের মাঠ কাপানো খেলোয়াড়েরা পুরো বিশ্বজুড়ে সমাদৃত এবং সকলের আগ্রহের পাত্র। যুগে যুগে ফুটবল ইতিহাসকে শাসন করেছে বিশ্বের নামীদামী সব খেলোয়াড়। এ তালিকার শীর্ষে ফুটবল জাদুকর পেলে, ম্যারাডোনাদের নাম নিঃসন্দেহে সবার উপরে। তবে বর্তমান সময়ের ফুটবল জাদুকর বা ফুটবল বিধাতা যদি বলা হয়ে থাকে তবে একজনের নাম ফলাও করে বলা যায়, তিনি আর কেউ নন – ছ’ ছ ‘বারের ব্যালন ডি’অর জিতে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখানো  ফুটবলার লিওনেল মেসি। অনেকে অবশ্য তাকে ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সেরাদের তকমাও দিয়ে থাকে৷

পুরো নাম-“ লিওনেল আন্দ্রেস মেসি কুচ্চিতিনি”। ১৯৮৭ সালের ২৪ জুন মধ্য আর্জেন্টিনার রোজারিওতে জন্মগ্রহণ করেন।পিতা হোর্হে হোরাসিও মেসি ইস্পাতের কারখানায় কাজ করতেন এবং মা সেলিয়া মারিয়া কুচ্চিত্তিনি ছিলেন একজন খণ্ডকালীন পরিচ্ছন্নতা কর্মী। তাদের পৈতৃক আদি নিবাস ছিলো ইতালির আকোনা শহরে। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মেসি স্থানীয় ক্লাব গ্রান্দোলির হয়ে ফুটবল খেলা শুরু করেন যার কোচ ছিলেন তার বাবা হোর্হে। ১৯৯৫ সালে মাত্র ৮ বছর বয়সে মেসি রোজারিও ভিত্তিক ক্লাব নিওয়েল’স ওল্ড বয়েজে যোগদান করে। উক্ত ক্লাবে মেসির যোগদানের পর থেকে ক্লাবটি স্থানীয় পরাশক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় এবং মেসি হয়ে ওঠেন ক্লাবটির একক অপরাজেয় অধীশ্বর। স্থানীয়ভাবে ক্লাবটি “মেশিন অফ’ ৮৭” (machine of ’87) নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলো। ক্লাবের সকলের জন্মসাল ১৯৮৭ হবার কারণে তাদের এ নামে ডাকা হতো।

সবকিছুই স্বাভাবিক চলছিলো কিন্তু বাধ সেধে দাড়ায় যখন মেসির বয়স  এগারো বছরে এসে ঠেকে। গ্রোথ হরমোনের(growth hormone) সমস্যায় ভুগতে থাকেন এই লিটল জিনিয়াস। তৎকালীন রোজারিওর অন্যতম ক্লাব রিভার প্লেট  মেসির খেলোয়াড়ি জীবনের প্রতি তাদের আগ্রহ প্রকাশ করে কিন্তু মেসির চিকিৎসা খরচ বহন করার মতো ব্যয়ভার বহনে তাদের অপারগতা ছিলো, ফলে মেসিকে তার গ্রোথ হরমোনাল ডিসফাংশন নিয়ে বেশ ঝুঝতে হয়েছে। এ সময়ে তার সার্বিক চিকিৎসা খরচে প্রতি মাসে প্রায় ৯০০ মার্কিন ডলারের মতো ব্যয় হয়। ইতিমধ্যেই বার্সেলোনার তৎকালীন ক্রীড়া পরিচালক কার্লোস রেক্সাস আর্জেন্টিনা সফরে আসেন। তিনি সে সময়ে ক্ষুদে মেসির প্রতিভা সম্পর্কে জানতে পারেন এবং তিনি মেসির খেলা দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। নিওয়েল’স ওল্ড বয়েজ এর এক প্রীতি ফুটবল ম্যাচের দর্শক বনে যান বার্সেলোনার প্রতিনিধি কার্লোস রেক্সাস। সেসময়ের উক্ত ম্যাচে তিনি মেসির অসাধারণ প্রতিভা দেখে মুগ্ধ ও অভিভূত হয়েছিলেন এবং তিনি এতোটাই পুলকিত  হয়েছিলেন যে সেসময়ের ম্যাচ শেষেই মেসির বাবা হোর্হের সাথে মেসিকে বার্সেলোনার যুবদলে সম্পৃক্ত করতে উদ্ধত হন। সেসময় তার কাছে কোন কাগজ না থাকায় একটি ন্যাপকিন পেপারে মেসির যাবতীয় চিকিৎসা খরচ বার্সেলোনা বহন করবে এই শর্তে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এরই সাথে সাথে মেসি বার্সেলোনার যুব প্রকল্পের সাথে নিজের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করেন এবং সূদুর স্পেনের উদ্দ্যেশ্যে নিজের স্বপ্নপূরণের সিড়ির আঙিনায় পাড়ি জমান। মেসি তার বাবা হোর্হেকে নিয়ে বার্সেলোনায় পাড়ি জমানোর পরে সেখানে বার্সেলোনার যুব একাডেমি লা মাসিয়া’র মাধ্যমে তাকে সভ্য করে নেওয়া হয় এবং স্পেন ফুটবল তথাপি বার্সেলোনার ফুটবল ছন্দের সাথে মেসির প্রতিভার সংমিশ্রণে মেসি ধীরে ধীরে ক্রমেই হয়ে ওঠেন অপরাজেয় ও অপ্রতিরোধ্য। তৎকালীন সময়ের বার্সেলোনার সেরা খেলোয়াড়  রোনালদিনহো বার্সেলোনার যুবদলের একটি প্রীতি ম্যাচের দর্শক হয়ে গণমাধ্যমকে জানান দেন যে, বার্সেলোনার সেরা খেলোয়াড় এখনো যুব একাডেমিতে খেলে। ঠিক তখনও বিশ্ব আন্দাজ করতে পারেনি এই যুবকটিই একদিন ধীরে ধীরে  বিশ্ব রেকর্ডগুলো ভেঙে নিজের নামে রেকর্ডবুকের সম্ভার তৈরি করবে।

ব্যাক্তিগত জীবনে তার বেশ কয়েকজন বান্ধবী থাকলেও ছোটবেলার বান্ধবী  আন্তনেলা রোকুজ্জোর সাথে ২০০৮ সাল থেকে বসবাস শুরু করেন এবং ২০১২ সালের ২রা নভেম্বর রোকুজ্জো এবং মেসি তাদের প্রথম সন্তান থিয়াগোর জনক জননী হন। আবার ২০১৫ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর  তাদের জীবন জুড়ে নতুন সদস্য হিসেবে আসে মাতেও। ২০১৭ সালের ১ জুলাই বেশ সাড়ম্বরে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন মেসি রোকুজ্জো জুটি৷

বর্তমান দিনে মেসি কিছুটা স্পেনীয় ভাষায় কথা বলেন যেমনটা রোজারিওর স্থানীয় মানুষরা কথা বলেন। মেসি স্পেনে থাকা স্বত্তেও রোজারিও এবং তার পরিবারের সদস্যদের সাথে সুহৃদ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেন। তিনি এখনো রোজারিওতে তার বন্ধুদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করেন যাদের অধিকাংশই “দ্যা  মেশিন অফ ‘৮৭” এর সদস্য ছিলেন।

২০০৭ সালে মেসি,  “লিও মেসি ফাউন্ডেশন ” প্রতিষ্ঠা করেন। মেসির প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থাটি শারিরীক প্রতিবন্ধকতা ও সুরক্ষিত নয় এমন শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতকরণে কাজ করে। মেসির নিজের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাকে মানসিকভাবে নাড়া দেয় ফলে, তিনি আর্জেন্টিনার রোগাক্রান্ত শিশুদের স্পেনে নিয়ে গিয়ে শিক্ষা, চিকিৎসা থেকে শুরু করে যাবতীয় ব্যয়ভার ও চ্যারিটিমূলক কর্মকান্ড এ সংগঠনের মাধ্যমে চালিয়ে থাকেন।

২০১০ সালের ১১ মার্চ মেসি ইউনিসেফ (UNICEF)  এর শুভেচ্ছা দূত হিসেবেও নিযুক্ত হয়েছিলেন।  

এক অপ্রতিরোধ্য ফুটবল যোদ্ধা হিসেবে নিজেকে পরিণত করার পিছনে পরিশ্রম পরায়ণতার দিক থেকে তিনি একজন অতুলনীয় অ্যাথলেট। ফুটবল ইতিহাসে ক্লাব ফুটবল থেকে শুরু করে পেশাদারি জাতীয় ফুটবল – আর্জেন্টিনার হয়েও প্রায় সব রেকর্ড কিং লিওর দখলে। ফুটবলের সকল আধারে বিচরণ স্বত্তেও একটি না পাওয়া তার নির্ঘুম রজনীর কারণ হয়ে রয়ে যায় তা- বিশ্বকাপ। মেসির জন্য  কি বিশ্বকাপ স্বপ্নই থেকে যাবে? নাকি তিনি অপরাজেয় তকমার পরিপূর্ণ ব্যবহার করে ফুটবল বিশ্বকে শাসন করে বিদায় নিবেন এটাই এখন দেখবার পালা।

সর্বশেষ নিবন্ধ

ফেসবুকে সারথি

শেয়ার করুন