‘রিচার্ড সোর্গে: গুপ্তচরবৃত্তির সম্রাট’

যুদ্ধ বা সরকারি কূটকৌশল রক্ষার্থে প্রত্যেক দেশের সরকারকেই বিভিন্ন সময়ে গুপ্তচরবৃত্তির আশ্রয় নিতে হয়েছে। তবে কোনো কোনো ঘটনাপ্রবাহ এই প্রবণতাকে আরো বৃদ্ধি করেছে। ধারণা করা হয়, পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি গুপ্তচরবৃত্তির ঘটনা ঘটেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং মার্কিন-সোভিয়েত স্নায়ুযুদ্ধ ও তৎকালীন সময়ে। এই দু’টিরই সংঘটনকাল ছিল বিংশ শতাব্দী। এই শতাব্দীতেই পৃথিবীজুড়ে গুপ্তচরবৃত্তির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। বিংশ শতাব্দীর তুখোড় কয়েকজন গুপ্তচরের তালিকা করা হলে, রিচার্ড সোর্গের নাম থাকবে সর্বাগ্রে। ব্রিটিশ গোয়েন্দা কর্মকর্তা ইয়ান ফ্লেমিং সোর্গেকে আখ্যায়িত করেছেন ‘ইতিহাসের দুর্দান্ততম গুপ্তচর’ হিসেবে। আজ জেনে নেয়া যাক গুপ্তচরবৃত্তির সম্রাট রিচার্ড সোর্গে সম্পর্কে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা ট্রটস্কির অভিপ্রায় ছিল বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছড়িয়ে দেয়ার। সেই লক্ষ্যে তিনি গড়ে তুলেছিলেন চৌকস এক গুপ্তচর বাহিনী। রিচার্ড সোর্গে ছিলেন এই বাহিনীর অন্যতম প্রধান একজন সদস্য। লিওন ট্রটস্কি পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেননি। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ট্রটস্কি’র গুপ্তচরদের প্রশংসনীয় সাফল্য থাকলেও সোভিয়েত ইউনিয়নের উচ্চপর্যায়ের লোকজন এই গুপ্তচরদের নিজেদের জন্য হুমকি বলে মনে করতেন। সেকারণেই বিভিন্ন সময়ে সঠিক তথ্য দিলেও সোর্গে এবং এই গুপ্তচর বাহিনীর অবদান এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। অনেককেই ৩০’র দশকে দেশদ্রোহী হিসেবে হত্যা করা হয়। জোসেফ স্ট্যালিন নিজেও এদের তেমন বিশ্বাস করতেন না। তবে স্ট্যালিনের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা এনকেভিডি সোর্গেকে নির্ভরযোগ্য হিসেবেই মনে করতো।

রিচার্ড সোর্গের সাংকেতিক নাম ছিল রামসে। সোর্গের জন্ম ১৮৯৫ সালে তৎকালীন রুশ সাম্রাজ্যের ককেশাস পার্বত্য অঞ্চলে। জাতিগতভাবে তাঁর মা রুশ হলেও বাবা ছিলেন জার্মান। তাই খুব অল্প বয়সেই সোর্গে তাঁর বাবার সাথে জার্মানিতে চলে আসেন। এখানেই তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি জার্মান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন, অংশ নেন বিশ্বযুদ্ধে। যুদ্ধ শেষে পড়াশোনা শুরু করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং অর্থনীতিতে নিয়ে। এর কিছুদিন পরেই তিনি যোগ দেন জার্মান সমাজতান্ত্রিক দলে। এর ফলে তাঁকে সরকারের রোষানলে পড়তে হয়। যার ফলশ্রুতিতে চাকরিচ্যুত হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে পাড়ি জমান সোর্গে। এখানেই তাঁর গুপ্তচরবৃত্তির হাতেখড়ি ঘটে। এ সময় তিনি ইংল্যান্ড, স্ক্যান্ডিনেভিয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেন। সব ক্ষেত্রেই সোর্গে তার দুর্দান্ত কর্মদক্ষতার প্রমাণ দেন। যার ফলে নিয়োগ পান সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা জিআরইউ-তে। আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব হিসেবে মূল পরিচয় গোপন রেখে তিনি যোগ দেন জার্মান পত্রিকা ‘ফ্রাংকফুটের জেইতুং’ এর সংবাদদাতা হিসেবে। ফলে তাঁর নতুন কর্মস্থল হয়ে উঠে জার্মানি। ১৯৩৩ সালে তাঁকে সাংহাইতে পাঠানো হয়। সেখানে কৃষিবিদ হিসেবে তিনি সুখ্যাতি লাভ করেন। পাশাপাশি লেখালেখির কাজও পুরোদমে চলতে থাকে, বইও প্রকাশ করেন সোর্গে। হিটলার ক্ষমতায় আসলে সোর্গে পুনরায় জার্মানিতে চলে আসেন। এসময় নাৎসিদের সাথে তাঁর সখ্যতা গড়ে উঠে। নাৎসিদের উপর মহলেও তাঁর নিয়মিত যাতায়াত ছিল৷ তিনি প্রকাশ্যে সোভিয়েতবিরোধী মন্তব্য করতেন এবং নাৎসিদের প্রশংসা করতেন, যার ফলে জার্মান সরকার তাঁকে নিয়ে কখনোই সন্দেহ করেনি।

১৯৩৩ সালেই সংবাদদাতা হিসেবে সোর্গে জাপানে যান। বুদ্ধিমত্তা ও কৌশলের ফলে খুব অল্প সময়েই জাপানের সরকারি মহলে তিনি সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। জার্মান দূতাবাসের বিভিন্ন কর্মকর্তা, কর্মচারী এমনকি তাদের সহধর্মিণীদের সাথেও সোর্গের বন্ধুত্ব ছিল। যার ফলে তাঁর গোয়েন্দাচক্রটি ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। সাংবাদিক পরিচয়ের আড়ালে সোভিয়েতের প্রতি জাপানিদের পদক্ষেপ কী হতে পারে সে সম্পর্কে তিনি নজর রাখতেন। সোর্গেই সর্বপ্রথম সোভিয়েত সরকারকে সংবাদ পাঠিয়েছিলেন যে, সোভিয়েত আক্রমণের কোনো পরিকল্পনা-ই জাপানের নেই। বরং জাপানের মনোযোগ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষিতে এই বার্তাটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা সোভিয়েতদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল জাপানিরা তাদের আক্রমণ করবে। সোভিয়েত আর্মির প্রস্তুতিও ছিল জাপানের সম্ভাব্য আক্রমণ ঠেকানোর। কিন্তু সোর্গের তথ্যের ফলে সোভিয়েত সরকার সে সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটে। সোর্গের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সোভিয়েতরা তাদের বিরাট বাহিনী পশ্চিম সীমান্তে চালান দেয়। এর ফলাফল স্বরূপ বাড়তি সেনাদল আর ভয়ংকর শীতের প্রভাবে মস্কোর যুদ্ধে প্রথমবারের মত ভরাডুবি ঘটে জার্মান সৈন্যদের। যার পুরো কৃতিত্ব সোর্গে প্রেরিত ঐ বার্তার, যেটি সোভিয়েতকে মস্কো রক্ষার্থে সাহায্য করে।

গুপ্তচর হিসেবে সোর্গের আরো একটি বড় কৃতিত্ব হলো সম্ভাব্য জার্মান হামলা সম্পর্কে সোভিয়েত সরকারকে আগেভাগেই সতর্ক করে দেয়া। ১৯৩৯ এর আগস্টে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং জার্মানির মধ্যে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এটি সোভিয়েত-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তির শর্ত ছিল, দেশ দু’টি নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত হবে না। কিন্তু হিটলার যে চুক্তিভঙ্গ করে সোভিয়েত আক্রমণ করতে যাচ্ছেন, সেটি সোর্গে জানতে পেরেছিলেন। হিটলারের সোভিয়েত হামলার পরিকল্পনা ছিল অত্যন্ত গোপনীয়, জার্মান পররাষ্ট্র দপ্তর, এমনকি মুসোলিনি পর্যন্ত এটা জানতেন না। এ থেকেই ধারণা পাওয়া যায় সোর্গে গুপ্তচর হিসেবে কতটা দুর্ধর্ষ ছিলেন। সোর্গে চুক্তিভঙ্গের সম্ভাবনার পাশাপাশি এও জানিয়েছিলেন, জার্মান আক্রমণ ঘটবে ১৯৪১ এর ২০ জুন এবং জার্মানরা অন্তত দেড়শো ডিভিশন সৈন্য সোভিয়েত সীমান্তে মজুত করছে। জোসেফ স্ট্যালিনও সোর্গের এই গোয়েন্দা তথ্য বিশ্বাস করতে পারেননি। কিন্তু পরবর্তীতে সোর্গের তথ্যই সত্য প্রমাণিত হয়। ১৯৪১ সালের ২২ জুন বিশাল সৈন্যবহর নিয়ে হিটলারের বাহিনী সোভিয়েত আক্রমণ করে বসে। সোর্গে যদি এই তথ্য দিতে না পারতেন, তবে সোভিয়েত সেনাবাহিনীকে এর চরম মূল্য দিতে হতো।

সোর্গের প্রেরিত বহু তথ্যের মধ্যে এই দু’টি তথ্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং কার্যকরী মনে করা হয়। ধারণা করা হয়, জাপানিদের সোভিয়েত আক্রমণ না করা এবং জার্মানদের সোভিয়েত আক্রমণ করার সংবাদ যদি সোর্গে দিতে না পারতেন, তবে হিটলার ও তাঁর বাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল করে নিতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চূড়ান্ত ফলাফল-ই তখন বদলে যেতো। এ কারণেই সোর্গেকে শতাব্দীর সেরা গুপ্তচর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু ইতিহাসখ্যাত এই গুপ্তচরের জীবনের শেষ পরিণতি সুখকর ছিল না। পরিচিতজনদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ১৯৪১ সালের ১৭ অক্টোবর তাঁকে জাপানে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৪৪ সালের ৭ নভেম্বর রিচার্ড সোর্গেকে টোকিও’র একটি কারাগারে ফাঁসি দেওয়া হয়। সরকারি গোপনীয়তার কারণে তাঁর এই বীরত্বগাঁথা সর্বসাধারণের কাছে দীর্ঘদিন অজানা ছিল। সোর্গের মৃত্যুদণ্ডের প্রায় বিশ বছর পর, পূর্ব জার্মানিতে গুপ্তচরদের একটি মহা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই এই দুর্ধর্ষ গুপ্তচরের কীর্তির কথা মানুষ প্রথমবার জানতে পারে। পরবর্তীকালে সোভিয়েত সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান, ‘হিরো অব দ্যা সোভিয়েত ইউনিয়ন’ খেতাবে ভূষিত করে।

সর্বশেষ নিবন্ধ

ফেসবুকে সারথি

শেয়ার করুন