বঙ্গবন্ধু বললেন ‘মাস্টর তোমার ছুটি নাই, তোমার ছাত্র আসতেছে’

ঢাকা, ১৭ অক্টোবর, ২০২৩ (বাসস) : পঁচাত্তরের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত ছিল শেখ রাসেলের শিক্ষাজীবন। এদিনও তিনি তার গৃহশিক্ষক গীতালি চক্রবর্ত্তীর (সগুপ্তা) কাছে পড়েছেন। গীতালী রাসেলকে পড়ানোর পরও এনি রাত ১১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত ৩২নং-এর বঙ্গবন্ধু ভবনে ছিলেন। পরের দিন আর সুযোগ হয়নি পড়ানোর। কারণ, এদিন কাল রাতে জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যের মত এই নিষ্পাপ শিশুকেও ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়।

এদিন সন্ধ্যার আগে গীতালি যখন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে পড়াতে যান তখন রাসেল বাড়িতে ছিলেন না। মায়ের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলেন। গীতালি একা একা অপেক্ষা করছিলেন। একটা সময় চলে যাওয়ার কথাও ভাবেন। এমন সময় বঙ্গবন্ধু উপরে এসে স্বভাবসূলভ ভঙ্গিতে বলে উঠেন ‘মাস্টর তুই একা কেন, ছাত্র কোথায়?’ বঙ্গবন্ধু গীতালিকে মাস্টর বলে ডাকতেন। রাসেল বাড়িতে নেই শুনে তিনি গীতালিকে নিচে বঙ্গবন্ধুর গাড়ি আছে, তাতে করে চলে যাওয়ার কথা বলেন। তখন রমা বলেন, রাসেল আপুকে থাকতে বলেছেন। এসে পড়বে। বঙ্গবন্ধু তখন ফোন করে জেনে নেন এবং গীতালিকে আবার উ”চস্বরে বলেন ‘মাস্টর তোমার ছুটি নাই, তোমার ছাত্র আসতেছে।’

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ সন্তান শেখ রাসেলকে নিয়ে এসব স্মৃতিচারণ করেছেন তার (রাসেল) গৃহশিক্ষক গীতালি চক্রবর্ত্তী। ১৯৭২-এর আগস্ট থেকে ১৯৭৫ এর ১৪ আগস্ট পর্যন্ত রাসেলের গৃহশিক্ষক ছিলেন তিনি। গীতালি তখন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষের বাঙলা বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। বর্তমানে তিনি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বসবাস করছেন।
এর আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনা করে ২০০৫ সালে অবসরে যান। তিনি বর্তমানে সংক্ষিপ্ত সফরে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন।

শেখ রাসেলকে নিয়ে দীর্ঘদিনের জমে থাকা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি কয়েক ‘বাসস’ এর সঙ্গে ফা কথা বলেছেন। তবে, গীতালি আগেই জানিয়ে দেন, শেখ রাসেল ও তাঁর সম্পর্কটা ছিল এক বিচিত্র সুরে বাঁধা। সেখানে প্রলিত সুর-তাল-লয় বা ছন্দের বালাই ছিল না। ছিল নিত্য নব নব আনন্দের ও গভীর ভালোবাসার অনুরণিত অনুরাগ। ‘ওর সম্পর্কে আমার মুখে বলা যত সহজ, লেখা তত সহজ নয়। অনুভব গভীর হলে, ভাষা সেখানে অসহায়’ বলেন শেখ রাসেলের এই শিক্ষক।

গীতালি রাসেলকে আদর করে ডাকতেন বুঁচু। রাসেল তার শিক্ষককে সম্বোধন করতেন আপা, আপু এবং শেষ দিকে আপুমনি বলে। তিনি বলেন, ১৯৭২ জুলাই কি আগস্ট মাস থেকে ছোট্ট রাসেলকে ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতেই পড়াতে যেতেন। অবশ্য অল্প কিছুদিন গনভবনেও পড়িয়েছেন। সবশেষ পঁচাত্তরের ১৪ আগস্ট পড়িয়েছেন। এদিনেই ছিল রাসেলকে পড়ানোর শেষ দিন। এদিন রাত ১১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত তিনি ৩২ নং-এর বঙ্গবন্ধু ভবনে ছিলেন।
তিনি বলেন, বয়সে অনেক ছোট হলেও শেখ রাসেলের হৃদয়টা ছিল অনেক বড় ও উদার। বিশেষকরে সাধারণ মানুষের প্রতি ছিল তার প্রগাঢ় ভালোবাসা। শিশু বয়সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর মানসিকতা ছিল তার মধ্যে। তার শিশু সুলভ সমস্ত আচরণ বা কর্মকান্ডের মধ্যে কেবলই সরলতা নয়, আদর্শিক ও দার্শনিক একটা ভাবও ছিল। এমনকি কোন বিষয়ে কঠিন অবস্থানে থাকলেও যুক্তি দিয়ে তাকে বশ করানো যেতো।

সাধারণ মানুষের প্রতি রাসেলের কেমন ভালোবাসা ও দায়িত্ব বোধ ছিল তার একটি ঘটনা সবিস্তারে তুলে ধরেছেন গীতালী। তিনি বলেন, তখন শীতের নি। ৩২ নম্বরের পাশের বাড়িতে রাসেল নামে আর একটি শিশু ছিল। রাসেল প্রায় সময় তার সাথে খেলতো। এদিন এক বুড়ি (বৃদ্ধা) পাশের বাড়িতে ভিক্ষা করতে আসেন। এসময় বাড়ি থেকে বলা হয়, ভিক্ষা নয়, বাড়ির কি একটা কাজ করে দিলে এক টাকা দেয়া হবে। বুড়িটি রাজি হন। কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার পর বুড়িকে মাত্র ২৫ পয়সা প্রদান করা হয়। এতে তিনি কান্নাকাটি করতে করতে ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন। এ ঘটনা কিশোর রাসেলের মনে সাংঘাতিক কাটে এবং কষ্টয়ে। রাসেল সেই বুড়িমাকে পরম যত্নে তুলে এনে গেটের সামনে বসিয়ে রাখেন। বলেন আব্বা (বঙ্গবন্ধু) আসলে কথা বলিয়ে দিবেন। বিচার চাইতে হবে। তিনি বিচার করে দেবেন। দুপুরে তাকে খাবারও দেয়া হয়। এ দিকে শীতে বুড়িমার জুবুথুবু অবস্থা। কখন কি হয় বলা যায় না। কিন্তু রাসেলের এক কথা ‘আব্বা আসলে বিচার হবে। তারপর বুড়িমা যাবেন।’ পরে রাসেলকে প্রস্তাব দেয়া হয়, বুড়িকে যদি রাতের খাবার এবং আরো বেশি টাকা দেয়া হয়, তাহলে ছেড়ে দেয়া যাবে কি-না। সম্ভবত ‘বেশি টাকা দেয়া হবে, এই প্রস্তাবে শেখ রাসেল রাজি হয় বুড়িকে ছেড়ে দিতে। তবে, আব্বা আসলে বুড়ির পক্ষ থেকে এ অনিয়মের প্রতিকার চেয়ে বিচার চাওয়া হবে বলে জানান দিয়ে রাখে সে।

পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট কালরাতে বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে ঘাতকের নির্মম বুলেট মাত্র ১১ বছরেই কেড়ে নিয়েছিল ইতিহাসের মহাশিশু শেখ রাসেলের প্রাণ। মৃত্যুর আগে আল্লাহর দোহাই দিয়ে না মারার জন্য খুনিদের কাছে আর্তি জানিয়েছিলেন শেখ রাসেল। সেদিন রাসেলের এই আর্তচিৎকার স্রষ্টার আরশ কেঁপে উঠলেও টলাতে পারেনি খুনী পাষাণদের মন।

গীতালি সাধারণত বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠা কন্যা শেখ রেহানার ঘরেই রাসেলকে পড়াতেন। সবসময় তালামারা থাকে এমন একটি কক্ষেও রাসেলকে পড়িয়েছিলেন তিনি। তবে, শেষ পড়ানোটা হয়েছিল সম্ভবত শেখ রেহানার কক্ষে।
বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা ও শেখ জামালের স্ত্রী রোজী জামাল ও (১৯৭৪) তার ছাত্রী ছিলেন।
পড়তে এসেই রাসেল আপুকে জানায়, ‘ওদিনতো কোক খাইতে দেন নাই। আইজ কোকটা আনি। জামাল ভাই খাইতে পারে নাই। কোল্ড ড্রিংকস বিশেষকরে কোকের প্রতি রাসেলের ছিল সাংঘাতিক দুর্বলতা। প্রতিনি একটি করে কোক তার জন্য বরাদ্ধ থাকতো। তবে, প্রতিদিন যাতে রাসেল কোক না খায় সে ব্যাপারে চেষ্টা করতেন গীতালি। বুঝাতেন কোকে দাঁত নষ্ট হয়ে যায়। আরো আরো অনেক ক্ষতি হয়। পরে সিদ্ধান্ত হলো প্রতিনি খাওয়া হবে না। যেদিন খাবেন অর্ধেক, পরের দিকে দেখা যেতো ফ্রিজে কোক থাকতো না। শেখ জামাল ফ্রিজে রাখা রাসেলের জন্য বরাদ্ধকৃত কোক কখনো কখনো খেয়ে ফেলতেন। এ নিয়ে রাসেল ‘জামাল ভাইয়া তার কোক খেয়ে ফেলেন,’ এমন অনুযোগ করতেন আপুর

লেখক: শেখ রাসেলের শিক্ষিকা।

সর্বশেষ নিবন্ধ

ফেসবুকে সারথি

শেয়ার করুন