শেখ রাসেল: শিউলি-গন্ধরাজ, নবান্নে কৃষকের হাসি

‘আমি জন্মের প্রয়োজনে ছোট হয়েছিলাম, এখন মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হচ্ছি’ কবি ‘নির্মলেন্দু গুণের’ ‘স্ববিরোধী’ কবিতার এই দুই চরণ সবার জন্মজীবন বোধের সাক্ষী হতে পারে না। কিছু কিছু জীবন বিকশিত হবার পূর্বেই চরম নৃশংসতায় লুট হয়ে যায়। তখন ফুলের বাগান মিথ্যে হয়ে যায়, পাখি গাইতে ভুলে যায়, কবিতাও ছন্দ হারায়। প্রস্ফুটিটত হবার পূর্বে উর্দি-বুটের থাবায় লুট হওয়া এমনই এক স্বপ্নের নাম শেখ রাসেল।

১৯৭৫ এর ১৫’ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যায় রেহাই হয়নি বঙ্গবন্ধুর সর্বকনিষ্ঠতম পুত্র শেখ রাসেলেরও। শিউলি-গন্ধরাজের সুবাস নিয়ে, নবান্নে কৃষকের মুখে হাসির কারণ হিসেবে ১৯৬৪ এর ১৮’ই অক্টোবর জন্ম নেয়া শেখ রাসেলের জীবন প্রদীপ সেদিন এক লহমায় নিভে যায়। ধানমণ্ডি ৩২ নাম্বারের বাড়ি বনে যায় কৃতঘ্ন ষড়যন্ত্রকারীদের সাক্ষী শ্মশান।

মৃত্যুকে দেখে ফিরে আসবার সুযোগ নেই। তাই হয়ত প্রত্যেকেই জন্মকে স্বাগত জানায়। যদিও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং লৈঙ্গিক রাজনীতি ভেদে তা বদলেও যায়। কিন্তু সব ছাপিয়ে গর্ভধারিণী মায়ের ‘কষ্ট-সমুদ্র’ স্বর্গসুখে বদলে যায় যখন তার সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশু তার পাশে কেঁদে উঠে। সম্ভবত ঐ একবারই মা তার সন্তানকে কাঁদতে দেখেও আনন্দ পান। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতেন্নুছা মুজিবও হয়ত শিশুপুত্র শেখ রাসেলের জন্মদিনে এমন অনুভূতি অনুভব করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর সর্বকনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের জন্মতিথি বেশ আন্দোলিত করেছিল বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে। কারণ জীবন যুদ্ধে দৌড়ানো মানুষগুলোর মাঝে একজন নতুন শিখতে আসা প্রাণ এসেছে, এ যেন তাদের ফেলে আসা মুহূর্তগুলোকে নতুন করে উদযাপনের উপলক্ষ করে দিয়েছিল। এই আহ্লাদের সূচনা ঘটে বড় বোন শেখ হাসিনার মাধ্যমে। রাসেলের জন্মের পর নিজের ওড়না দিয়ে ভেজা মাথা পরিষ্কারের মাধ্যমে।

তাঁর নামকরণের বিষয়টিও বেশ প্রেরণাদায়ক। পিতা মুজিব তাঁর পছন্দের দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে সর্বকনিষ্ঠ পুত্রের নাম রাখেন। বার্ট্রান্ড রাসেল তখন বিশ্বের আইকন। কিউবা সংকট নিয়ে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া ও আমেরিকার মাঝে যুদ্ধ প্রায় আসন্ন। বার্ট্রান্ড রাসেল সেই অবস্থাকে শান্তির পথে রূপান্তরিত করেন এবং বিশ্বকে একটি পারমাণবিক যুদ্ধের কবল থেকে রক্ষা করেন।
বাঙালি সংস্কৃতিতে বরাবরই পরিবারের ছোটজনরা সর্বোচ্চ আদর ও শাসন লাভ করে। সে অনুযায়ী রাসেলও ছিল সবার প্রিয়। শেখ হাসিনার বেণী নিয়ে খেলায় মেতে উঠা, অন্যান্য ভাইবোন সাথে খুঁনসুটি করা, সবই পেয়েছিলেন তিনি। তাছাড়া জাতির পিতার উত্তরাধিকার হিসেবে কিছু ব্যতিক্রমী গুণের অধিকারীও ছিলেন। যেমন, শেখ হাসিনার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে হাত ছেড়ে দিয়ে ঐদিনই একবারে হাঁটতে শিখে গিয়েছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়টায় বেশ নিঃসঙ্গ যাপন ছিল রাসেলের। সেই অভাব ঘুচে যায় ভাগ্নে সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্মের মধ্য দিয়ে। জয় হয়ে উঠে তাঁর শেখার, শেখানোর এবং খেলাধুলার আনন্দ সঙ্গী। জয়ের প্রতি প্রবল দায়িত্ববোধও ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জন্ম নেয়া জয়ের গোলাবারুদের শব্দে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটত। এই সমস্যা মোকাবেলায় রাসেল সব সময় পকেটে তুলা রাখতেন। শব্দ হলেই জয়ের কানে তুলা গুঁজে দিতেন। গ্রামে খেলার সাথিদের সংগঠিত করা, তাদের জন্য চকলেট নেয়া, নতুন জামা নেয়া, এসব করতেবেশ আনন্দ পেতেন। অর্থাৎ মানুষের জন্য করতে পারার একটার ছিল তাঁর মাঝে।

জন্মলগ্ন থেকে রাসেল পিতার সংস্পর্শ কমই পেয়েছেন। এই অভিমান, শূন্যতার ফলাফল মাকেই আব্বা বলে ডাকতেন। পিতা-পুত্রের এই তৃষ্ণা ঘুচে দেশ স্বাধীন হবার মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধু রাসেলকে যেখানে যেখানে নেবার সুযোগ থাকত সব জায়গায় নিয়ে যেতেন। পোশাক পরিচ্ছদের ব্যাপারেও পিতা যেদিন কোট পরতেন সেদিন তিনিও নিজের প্রিন্স কোট পরতেন। এককথায় ঐটুকু বয়সে একধরণের আলাদা ব্যক্তিত্ববোধের আভাস পাওয়া গিয়েছিল।

এত এত সম্ভাবনা, সবি শেষ হয়ে যায় ১৫ই আগস্টে। জণ্ডিসটা না হলে বড় বোন শেখ হাসিনার সাথে জার্মানি যাওয়া হত নিশ্চয়ই। তাহলে সেদিন হয়ত আরেকটা স্বপ্ন বেঁচে যেত।

জাগতিক এই জীবনকালে মৃত্যুই প্রকৃত বাস্তবতা। তবে একে আলিঙ্গনেও চাই যথার্থ সময় এবং পদচিহ্ন রেখে যাবার সুযোগ। তাছাড়া স্বাভাবিক মৃত্যু প্রত্যেকের অধিকার। সেখানে বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও ছোট্ট রাসেলকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে এই দায় শুধু হত্যাকারীদের একার নয় বরং তৎকালীন সময়টায় নীরব ভূমিকা পালনকারীদেরও। তবু এত বেদনা বুকে নিয়েও, বেদনার শতদল মাড়িয়েও আমরা স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি ইতিহাসের সেই নারকীয় হত্যার বিচার সম্পন্ন হবার।

লেখক: মহামান্য রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব

সর্বশেষ নিবন্ধ

ফেসবুকে সারথি

শেয়ার করুন