‘স্মরণের আবরণে আমার বুঁচুসোনা শেখ রাসেল’

“হারিয়ে গেছে অন্ধকারে – পাইনি খুঁজে আর,
আজকে তোমার আমার মাঝে সপ্ত পারাবার!”
শেখ রাসেল ও আমার সম্পর্কটা ছিল এক বিচিত্র সুরে বাঁধা। সেখানে প্রচলিত সুর-তাল-লয় বা ছন্দের বালাই ছিল না। ছিল, নিত্য নব নব আনন্দের ও গভীর ভালোবাসার অনুরণিত অনুরাগ। ওর সম্পর্কে আমার মুখে বলা যত সহজ, লেখা তত সহজ নয়। অনুভব গভীর হলে, ভাষা সেখানে অসহায়। এ-মুহূর্তে আমি তেমনি অসহায়!

আমার ভেতরের অনুভূতিটুকু ফুটিয়ে তুলে সকলকে বোঝানোর ক্ষমতাও যেন আমি হারিয়ে ফেলেছি। তবুও, “ভাষাহারা মম বিজন রোদনা, প্রকাশের লাগি করেছে সাধনা”, সে অনেকগুলো বছর-বয়ে বেড়াচ্ছি বেদনার এই নীল বোঝাটা। লিখতে বসেছি, বারবার কলম আটকে যাচ্ছে। অতীতের সুখস্মৃতি আজ দুঃখের আঁধারের অবগুণ্ঠনে ঢাকা। সে স্মৃতি আজ, আমার ভারী বোঝা। চিৎকার করে যাচ্ছি, “এ বোঝা আমার নামাও বন্ধু নামাও-” কারোই যে এ বোঝা নামাবার ক্ষমতা নেই, তা আমি জানি। যতদিন বেঁচে আছি, রক্তে শিক্ত এ বেদনার বোঝা আমার সঙ্গী হয়েই আমাকে জড়িয়ে থাকবে। বুকের গভীরে যে দগদগে ঘায়ের সৃষ্টি হয়েছে, তা আমৃত্যু আমায় পুড়িয়ে খাবে। লিখতে যে বেশ কষ্ট হচ্ছে! আমি এগুবো কী করে? অতীত যে বর্তমান হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে, সেই অতীতকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া যাচ্ছে না তো! ছোট্ট একটি হাসিমাখা মুখ আমার সামনে দাঁড়িয়ে, অথচ সেই মিষ্টি মুখখানা ছুঁতে পারছি না, পারছি না আগের মতো করে আদর করতে! খুনসুটির খেলাটাও তো বন্ধ! দম আটকে আসছে, চোখ বুজে অনুভব করছি, আমার সামনেই অতীত বর্তমান রূপে জাগরূক! এ যন্ত্রণা বোঝাই কী করে? কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন

“অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেন
তার বক্ষে বেদনা অপার।”

আমি বিধাতার কাছ থেকে এই অলৌকিক আনন্দের ডালিখানা পেয়েছিলাম। আমার সেই আনন্দে ভরা ডালিখানা প্রলয় ঝড়ের আঘাতে ভেঙেচুরে কোথায় যেন হারিয়ে গেল! আজ খুঁজে ফিরছি, সে-ই আনন্দের অম্লমধুর, বেদনাবিধুর, অম্লান কিছু স্মৃতির ঐশ্বর্য্য।

অ-নে-ক গুলো বছর পার হলেও মনে হয়, এই তো সেদিনের ঘটনাগুচ্ছ! তারপরেও কোথা থেকে ছিঁড়বো সে স্মৃতির কুঁড়ি, বুঝে উঠতে পারছি না যে! সযত্নে আগলে রাখা সঞ্চিত স্মৃতির চারা গাছটাই আজ আমার একমাত্র সম্বল। সেখান থেকেই তুলতে হবে দু-চারটি এলোমেলো স্মৃতির অস্ফুট কুঁড়ি। সেই ছোট্ট গাছ থেকে কিছু স্মৃতির কুঁড়ি নিয়ে গাঁথা শুরু করি আমার হৃদয়ের রক্তেভেজা আখরের মালাখানি।

১৯৭২। এখন মাসটি মনে করতে পারছি না। খুব সম্ভবত জুলাই কী আগস্ট মাস। আমি তখন ছোট্ট রাসেলকে পড়াতে যেতাম ‘গণভবনে’। আজ ঐ ‘গণভবনের’ নাম বদলে রাখা হয়েছে ‘সুগন্ধ্যা’। এটা পড়া শুরুর প্রথম দিকের কথা। ওখানে বেশিদিন পড়াই নি। মনে হয় এক মাসের মতো বা কিছু বেশি হবে। এরপরে ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতেই পড়াতে যেতাম। তখন কী জন্যে যে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল, আজকে মনে পড়ছে না। সে যা-ই হোক, সে সময়টাতে সকাল নয়টা, কী দশটার দিকে পড়াতে যেতাম।

প্রথম দিনে খুব বেশি পড়াই নি। রাসেল কতটুকু জানে, ওকে কোথা থেকে শুরু করতে হবে, এসবেরই খোঁজ নেবার চেষ্টা করলাম। বুঝলাম, আমাকে আদি থেকেই শুরু করতে হবে। রাসেল তখন ক্লাস ওয়ানে পড়ছে। কয়েক মাস পরেই ওর বার্ষিক পরীক্ষা। ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস টু-এ উঠবে। সবকিছু, আমাকে বেশ তাড়াতাড়ি শেখাতে হবে। ওকে আ কার-ই কার থেকে শুরু করে অ ই ঈ উ সব শেখাতে হবে। সেদিনের মতো পাঠ শেষ করে, রাসেলকে বাসার জন্য কিছু প্রয়োজনীয় পড়া দিয়ে চলে এলাম। আমাকে ওদের গাড়িতেই বাসায় পৌঁছে দিল। গাড়ির যিনি ড্রাইভার ছিল, তার আসল নামটি কী ছিল আমি জানি না।
তাকে সকলে ‘মুন্সী’ নামেই ডাকতো। শুনেছি, সে অনেক পুরনো ড্রাইভার এবং খুব বিশ্বস্ত। শেখ রেহানার জন্মের আগে অথবা জন্মের সময় থেকেই মুন্সী ভাই এ-বাড়িতে গাড়ি চালাচ্ছে। সেদিন গাড়ির ভেতরেই মুন্সী ভাই আমায় কিছু প্রশ্ন করেছিল। যেমন : রাসেল পড়েছে কি না? কেউ আমার সাথে দেখা করেছে কি না? রাসেল আমাকে কিছু বলেছে কি না ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার সব প্রশ্নের উত্তর ছিলÑ “না।” “আজ তো প্রথম দিন, তাই, পড়ানো হয়নি তেমন। তবে যা যা রাসেলকে করতে বলেছি ও তাই করেছে। আজ সামান্য পড়েছে মাত্র।” মুন্সী ভাই হেসে বলল, “তাই? আপনারে পছন্দ হইছে তাইলে।” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এর মানে কী ড্রাইভার সাহেব?” প্রথম ক’দিন ড্রাইভার সাহেবই বলেছি। পরে মুন্সী ভাই ডেকেছি।

: না ও কিছু না। রাসেল ভাইয়া পড়াশুনা করতে পছন্দ করে না কি না, তাই জিজ্ঞাসা করলাম আপা। আপনি তো কইলেন পড়ছে। ভালো লাগলো শুইন্যা। এরপর তিন-চার দিন কেটে গেল, মুন্সী ভাইয়ের সেই একই প্রশ্ন-
: আইজ রাসেল পড়ছে আপা?
: আজ তিন-চার দিন আসছি ও তো কম হলেও পড়েছে। এ-কথা শুনে মুন্সী ভাই একটু হেসে বলল, আম্মার (রাসেলের মা) সাথে দেখা হইছে আপনার?
: না, এখনো দেখা হয় নাই।
: আম্মা মনে হয় লজ্জায় আপনার সাথে দেখা করতেছে না।
: কেন? লজ্জা কেন হবে? প্রথম দিন তো ওনার সাথেই কথা হলো।
: মুন্সী ভাই হেসে বলল, রাসেল ভাইয়ের কোনো টিচারই তো পছন্দ হয় না। একদিন দুইদিন পড়ার পর, “এই টিচার পছন্দ না” কইয়া, আসতে মানা কইরা দেয়। ভাইয়ার যে কত টিচার আসলো আর গেল! টিভি’তে একজনকে পছন্দ হইছে, তার কাছে সে পড়বে কইলো, তারে বাসায় আনলো, তার কাছে দুই-তিন দিন পড়ল ব্যাস, তারে পছন্দ না, কইয়া বিদায় করলো। এই রকম অনেককে করছে। তাই আম্মা হয়তো আপনার সাথে দেখা করে না। আপনারে আবার রাসেল ভাই কি কইয়া দেয়!

: আমাকে এখনো কিছু বলে নাই ড্রাইভার সাহেব।
এভাবে প্রতিদিন ড্রাইভার সাহেবের সাথে কথা হতো। মুন্সী ভাই-ই আমাকে রোজ প্রশ্ন করতো।
রাসেলকে পড়াতে মুন্সী ভাইয়ের এ-কথাগুলো পরবর্তীতে আমায় খুব সাহায্য করেছিল। আমি রাসেলকে অতি সহজেই বুঝতে পেরেছিলাম। ওকে পড়ানোর ন’দিনের মধ্যে মজার মজার বেশ ক’টি ঘটনা রয়েছে। আমি এখানে দু-একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছি।
ওই সময় রাসেল এক/দুই-এর সাথে পরিচিত ছিল না। তাই ওকে এক/দুই শেখাচ্ছি। তার এই এক/দুই-এর একশ পর্যন্ত সংখ্যা শিখতে মাত্র একটি দিন সময় লেগেছে। তাকে দুটো জিনিস আমি বলেছিলাম :
১. এক থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যার ছবি খেয়াল করে পড়ো ও দেখো এবং কোন সংখ্যার পর কোনটা রয়েছে তা মন দিয়ে দেখে নাও;
২. ‘ঊন’ শব্দটি মনে রাখো। এটা ছিল একটি খেলার মতো। ও দারুণ মজা পাচ্ছিল, সেটা আমি বুঝতে পারলাম। সুতরাং এই সুযোগটা কাজে লাগালাম। অল্প সময়ের মধ্যে সে শিখে নিল। পরের দিন সামান্য ভুল করলো; কিন্তু সেদিনই শিখে গেল সবটা। এরপর আর লিখতে ও পড়তে ভুল হয়নি। এবার অংক শেখাবার পালা।

প্রথমে হাতের আঙ্গুলের কর গুনতে শেখাতে শুরু করি। ছোট্ট ছোট্ট আঙ্গুলে যখন রাসেল কর গুনতো, আমার তা দেখতে খুব ভালো লাগতো। সে দারুণভাবে মনোযোগ দিয়ে গুনতো। তার ভ্রু যুগল থাকতো কুঁচকে আর চোখ থাকতো ছোট্ট আঙ্গুলগুলোর দিকে। ঐ চেহারাটা আমায় খুব আনন্দ দিতো বলে, আমি ওর কর গোনার সময় বলতাম-
: এ হে, আবার গোনো তো, আমি দেখতে পাইনি। ভুল হলো কি না বুঝতে পারলাম না। আবার গোনো।
: খেপে গিয়ে বলতো, আপনি অন্যদিকে ফিরা থাকেন ক্যান? একবারে দেখেন না ক্যান? এ-কথা বলে কখনো গুনতো, কখনো আবার স্বভাব চেতনায় বলে বসতো, আর গুনবো না, আপনি দ্যাখেন নাই ক্যান! এই শেষ কথাতেও আমি বেশ মজাই পেতাম।

কর গোনাটা শেখার পর খুব ছোট্ট ছোট্ট সংখ্যা দিয়ে যোগ শেখাতে শুরু করি। যেমন : ২ + ১ = কত? ২ + ২ = কত? এমনি সব। এই অংক শেখাতে গিয়ে আমি খেয়াল করলাম, ও অংক খুব একটা পছন্দ করছে না। যা হোক, পড়া শেষে অপছন্দকে মাথায় নিয়ে সেদিন বাসায় ফিরে এলাম।
পরের দিন পড়তে বসেই বলে দিল রাসেল, “আইজ আর অংক করবো না।”
আমার উত্তর ছিল, “কেন করবে না?”
: ভালো লাগে না।
: অংক তো আগে শিখতে হবে, পরীক্ষা তো এসে গেল, পাস করতে হবে তো।
সে কিছুতেই অংক করতে রাজি হলো না। অগত্যা আমাকে অন্য পড়ায় যেতে হলো। কিন্তু আমার মাথায় অংকটা রয়ে গেল। বেশকিছু সময় কাটিয়ে ওর পেন্সিল বক্সটা বের করে নিলাম। সেই বক্সে সাধারণ পেন্সিলের সাথে অনেকগুলো নানা রঙের পেন্সিল।
পেন্সিলগুলো দেখে আমার মাথা কাজ করতে শুরু করে দিল। মনে মনে খুশি হলাম। বললাম, “তোমার এতগুলো পেন্সিল?” রাসেল মাথা নাড়ল। হাতে পেন্সিলগুলো নিয়ে আমি গুনতে শুরু করলাম। আমাকে গুনতে দেখে ও নিজেই গুনতে চাইল। এটাই তো আমি চেয়েছিলাম। এবার ওকে অংক শেখাতে পারব। ঠিক তাই হলো। ঐদিন সে যোগ অংকটা শিখে গেল। মনে মনে দারুণ খুশি হলাম। আমার কাজ শেষ অথচ ও কিছুই টের পেল না।
এ ক’দিনে ও খানিকটা আমার কাছে এসে গেছে বলে আমার মনে হচ্ছিল। আমি বেশ খুশি। ভাবলাম সবকিছু ঠিকঠাক।

এক সপ্তাহ পার হয়েছে, কিন্তু কতদিন সে হিসাবটা আমার ছিল না। পড়াচ্ছি পড়াচ্ছি হঠাৎ করে রাসেল আমাকে জিজ্ঞেস করল, “আইজ আপনার কয় দিন?” আমি চমকে উঠলাম! সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো মুন্সী ভাইয়ের কথা, ভাবলাম, আজ আমার হয়তো শেষদিন। রাসেলকে বললাম, “কেন? আমি তো গুনে রাখিনি।”
একটুখানি হাসি দিয়ে বলল, “আইজ আপনার নয় দিন। আমারে যে সব চাইতে বেশি পড়াইছে, তার ছিল সাত দিন। আপনার আইজ নয় দিন।” মনে মনে প্রমাদ গুনলাম, সে-সাথে ভাবলাম, আজকেই শেষ হবে এ খেলা! সুতরাং, শেষবেলার চেষ্টা করতে হবে এখন আমাকে। রাসেল আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে বললাম, “তোমার পরীক্ষাটা শেষ হয়ে গেলে আমি আর আসবো না।” খানিকটা যেন চমকে উঠল রাসেল! ভ্রু দুটো কুঁচকে বলে উঠল, “আপনি আর আসবেন না?” আমি খুব স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলাম, “না, আসবো না তো! তবে, আমি আবার নতুন করে আসবো।”

সে ভ্রু কুঁচকে উত্তর দিল, “ক্যান আসবেন? আপনি তো পুরান!”
: বা রে! তুমি নূতন ক্লাসে উঠবে, নূতন বই কিনবে, আমি নূতন করে আবার আসবো। তোমার নতুন বইগুলোর সাথে পরিচয় করবো, তাহলে কি হলো বলো? আমার আবার নতুন করে আসা হলো না?
রাসেলের মুখে সুন্দর একখানা হাসি ফুটে উঠল। আমি থাকি আর না-ই থাকি, সে-মূহূর্তে দারুণভাবে উপভোগ করলাম সেই মিষ্টি হাসিখানা। ও যে শিশু ভোলানাথ! এসব যখন মনে হয় খুব কষ্ট হয় আমার।
চোখ দুটো বড্ড অবাধ্য হয়ে ওঠে। মনে হয় বুঁচু (পরবর্তী সময়ে আমি রাসেলকে আদর করে ‘বুঁচু’ নামেই ডাকতাম) আমার সামনে রয়েছে, হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারব।
: তাইলে পরীক্ষা পর্যন্ত আসবেন?
আমি মাথা নেড়ে বুঝালাম, হ্যাঁ তাই।
: পরীক্ষা শ্যাষ হইলে আর আসবেন না?
: পরীক্ষা শেষে তুমি যা খুশি করতে পারবে। আমি আসবো না। তবে তুমি যদি চাও, আমাকে ফোন করলে আসবো।
রাসেল ওর খাতাটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল
: আপনার ফোন নম্বরটা এইখানে লেইখ্যা দ্যান।
আমি তাই করলাম। বলাবাহুল্য, শেষ পরীক্ষাটা দিয়ে এসেই আমাকে ফোন করে এবং ঐদিনই আমাকে পড়াতে যেতে বলে।
ওই নয় দিনের মাঝেই আর একদিনের ঘটনা এখন বলছি। এ-সময়ের দিনগুলো ছিল আমার কাছে পরীক্ষামূলক। আমাকে রাগাবার বা খ্যাপাবার জন্য প্রতিদিন একটা-না-একটা কৌশল খুঁজে নিত।

এই নয় দিনের মাঝে একদিন সে রাগ করে পড়ার মাঝখানে ওর সমস্ত বই-খাতা-রাবার-পেন্সিল সব, সব মাটিতে ফেলে দিল। সমস্ত ঘরময় বই-খাতা-পেন্সিল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। যেভাবে জিনিসগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তা দেখলে যে কেউ রাগ করবে। আমিও প্রথমটায় হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। রাসেল এ কাজটি ক’রে, টেবিলের ওপর আর যা ছিল সেগুলো দু-হাতে আমার দিকে ঠেলে দিয়ে তার কনুই দুটো টেবিলের উপর রেখে, ছোট্ট ছোট্ট দু-খানা হাত দু-গালে লাগিয়ে বসে থাকল। মুখে প্রচ- রাগ। আমি একেবারে চুপ। আমার চোখে-মুখে কোনো রাগ বা বিরক্তির চিহ্ন ছিল না। রাসেল এভাবে রাগ করে বসে আছে, অপরদিকে আমিও উদাসীনভাবে আছি। মনে হচ্ছে কিচ্ছুটি হয়নি। এভাবে, দুজনের বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল। কারও মুখে কোনো কথা নেই। দুজনেই টুপ। আমি আর ওর দিকে তাকাচ্ছি না, কিন্তু বুঝতে পারছি, রাসেলের চোখ আমার দিকেই। সে আমাকে খুব করে খেয়াল করছে। কিন্তু কেন এমন করে দেখছে তা বুঝতে পারছি না। আর কতক্ষণ এভাবে থাকা যায়? হঠাৎ করে খুব বিরক্তির সুরে বলে উঠল রাসেল :
“আমি যে বই খাতা সব ফেলাইয়া দিলাম, এতে আপনার রাগ হয় নাই?”
মাথা নেড়ে বললাম “না।”
: ক্যান রাগ হয় নাই?
: বইগুলো তো আমার না। তোমার বই তুমি ফেলেছ, আমি রাগ করব কেন?
এ উত্তরটি রাসেল আশা করেনি। মনে হচ্ছিল, এ উত্তরে সে একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে। ভ্রু যুগল কুঁচকে বলল,
: রাগ হন, আপনি রাগ হন!
: বারে, আমি রাগ করব কেন? এ-কথা বলে আমি একটু হাসলাম।
: আপনি রাগ হবেন না?
: না।
: রাগ হবেন না ক্যান?
: বইগুলো তো আমার না, তাই আমার রাগও হবে না। এ-কথাগুলো মুখে ঠিকই বলছি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে চিন্তাও হচ্ছিল বেশ। এ খেলার শেষ কি হবে তা ভেবে।
: ভ্রু কুঁচকেই বললে, এই বইগুলা কে উঠাবে?
: যার বই সে-ই উঠাবে।
: মাথা নেড়ে বলল, আমি তো উঠাব না।
: আমিও উঠাব না। এভাবেই মাটিতে পড়ে থাকবে।
চোখে-মুখে তার চিন্তার ছাপ! হয়তো ভাবছে কী বিপদ! এ-সময়টা আমি খুবই উপভোগ করছিলাম। আমার বুঁচু ছোট্ট বাচ্চা বই তো আর কিছুই নয়! তাই ভাবনাটা শিশুর মতোই বইকি? সঙ্গে সঙ্গে সে বলে উঠলÑ
: বইগুলো না উঠালে কী হবে?
: আমি খুব শান্তভাবে সুর দিয়ে দিয়ে বললাম, এগুলো না উঠালে বিদ্যা হবে না, বুদ্ধি হবে না, বোকা হয়ে থাকতে হবে।
একটু ভেবে নিয়ে, আস্তে আস্তে চেয়ার থেকে মেঝেতে নামলো, মেঝেতে উপুড় হয়ে বসে, বই-খাতা-পেন্সিল-রাবার একটা একটা করে অনিচ্ছার সাথে গুছিয়ে, টেবিলের উপর আমার সামনে ওগুলো সব ধপ্ করে রেখে বললÑ
: এই ন্যান আপনার বই-খাতা!
: গুড বয়, বলে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে চেষ্টা করলাম, ও ঝট্ করে মাথাটা সরিয়ে নিল। আদর করতে পারলাম না।
শেষে আমি বই-খাতা সব গুছিয়ে ওর ব্যাগে ভরে রেখে দিলাম। এ নাটক যত তাড়াতাড়ি লিখে শেষ করলাম, সেদিন কিন্তু এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়নি। এ নাটক শেষ হতে বেশ সময় নিয়েছিল। এ নাটক শেষ হতে সময় নিয়েছিল বলে আমাকে এর পরেই ফিরে আসতে হয়েছিল।
আসার সময় ফরিদ (রাসেলদের কাজের ছেলে) আমাকে জিজ্ঞেস করল-
: আপা, রাসেল ভাইয়া কি আপনার উপর রাগ করছে? দেখলাম বই-খাতা সব সারা ঘরে ছড়ানো।
: ও কিছু না। ফরিদকে আর কিছু বললাম না।
: আবার দ্যাখলাম রাসেল ভাইয়াই সব কিছু গুছাইলো।
অবাক হয়েই কথাগুলো বলেছিল ফরিদ।
: হ্যাঁ, রাসেলই গুছিয়েছে সব।
বুঝতে পারলাম, বাসার সকলেই ওকে আর আমাকে খেয়াল করছে। এছাড়া, আমার মনে হলো, ওকে আর আমাকে নিয়ে সকলেই খানিকটা চিন্তিত আছে। রাসেলকে বুঝতে আমার খুব সময় নেয়নি। এর পেছনেও গল্প রয়েছে। সেই গল্পটা হলো, ওকে ‘আ-কার’, ‘ই-কার’ শেখাতে ‘আদর্শ লিপি’ বইখানা ব্যবহার করছিলাম। বলছিলাম-
: এগুলো যদি সব শিখতে ও মনে রাখতে পার, তবে তুমি যে কোনো বই পড়তে পারবে। বুঝলাম, আমার কথাটা ওর পছন্দ হয়েছে। ‘আদর্শ লিপি’ বইয়ের পাতা এক এক করে উল্টে যাচ্ছি আমি। মাঝে মাঝে ছবিগুলোও দুজনে মিলে দেখছি, সে-সাথে ‘আ-কার’, ‘ই-কার’গুলো শেখাতে শুরু করি। ‘য’ ফলা ও ‘র’ ফলাতে এসে একটা ছবির ওপর রাসেলের চোখ পড়ল। সে আমাকে জিজ্ঞেস করলÑ
: এই পাতায় কী আছে? এগুলো কী?
: একে বলে ‘য’ ফলা ও ‘র’ ফলা। ঐ পাতায় একটা ছবি ছিল, (আজকের ‘আদর্শ লিপি’তে এ ছবি আছে কি না আমি জানি না) সেই ছবিটার ওপর তর্জনী দিয়ে সে আমাকে জিজ্ঞেস করল-
: এইটা একটা বাঘ না আপা?
: হ্যাঁ। বাঘকে ‘ব্যাঘ্র’ বলে, তাই এই ছবি। আমি এ-কথা বলে ব্যাঘ্র বানানের ‘য’ ফলা ও ‘র’ ফলা কোনটা তাই দেখালাম। রাসেল কি ঐসব দেখছে?
ওর চোখ বাঘের দিকে। ছবিটা ছিল বাঘের মুখে একটা ছাগল, আর অনেকগুলো ছাগল ভয়ে চারদিকে দৌড়ে পালাচ্ছে। এই ছবিটা রাসেলকে আকর্ষণ করেছে। ছবিটার দিকে সে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে।
এটা আমি খেয়াল করলাম। বাঘের মুখে যে ছাগলটা সেই ছবিটার ওপরে ছোট তর্জনীটা রেখে আমাকে জিজ্ঞেস করলÑ
: দ্যাখেন আপা, বাঘটা কি বোকা, মুখের ছাগলটা তো বাঘের কামড়ে মইড়্যাই গেছে, ছাগলটা তো আর দৌড়াইতে পারবে না, বাঘটা তো অর মুখের ছাগলটা মাটিতে রাইখ্যা অন্য ছাগলগুলিরে ধরতে পারে। বাঘটা কি বোকা তাই না আপা?
এরপর কি আমার ছোট্ট বুঁচুকে চিনতে ভুল হয়?
আমার চিনতে ভুল হয়নি তো! ওর ভেতরে রয়েছে ওর মতোই একটি শিশুমন, যে মনটি ছবি দেখে এমন কথা বলতে পারে। ঐ মনটিকে বস করাই হবে আমার শিক্ষকতার অলংকার। ঐ অবুঝ মনটা আমার চাই।
এই মর্মার্থটাই আমি সেদিন উপলব্ধি করেছিলাম। সুতরাং বই-খাতা যখন রাসেল মাটিতে ফেলেছে, তখন আমার কোনো রাগ বা বিরক্ত হয় নাই। এখানে ছিল আমার নিজের ওপরে নিজের পরীক্ষা। বলা যায় চ্যালেঞ্জ। বাইরের লোক এ ঘটনা জেনে-শুনে হয়তোবা কোনো মন্তব্য করবেন, কিন্তু ওটা আমার কাছে ছিল নিছক একটা বাচ্চার অবুঝ কাণ্ড। অবুঝ বলেই তো করেছিল, বুঝতে পারলে এ কাজ সে করত না। অবুঝ বলেই না আমাকে বারবার ‘রাগ’ করতে বলেছে। এ-কথা শিশুমুখেই শোভা পায়।
ছোট ছোট অংক শেখার পর, তাকে অংক করতে দিলে সে মোটেও খুশি হ’তো না। অংকের প্রতি তার প্রবল অনীহা। দুটো-তিনটার বেশি অংক করতে চাইতো না। এমনি একদিন, তাকে ঐ রকম ছোট ছোট পাঁচটি অংক করতে দিয়েছি, সে অংক করে খাতাটা আমার দিকে ঠেলে দিল। আমি দেখি সে তিনটা অংক করেছে, দুটো করেনি। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম-
: তুমি তিনটে করেছো, আর দুটো করে ফেলো।
: ইচ্ছা করছে না।
: ও দুটো কে করবে?
: জানি না। বেশ জোরেশোরেই বলে দিল।
মহা মুশকিল হলো এবার। ওকে আরও বড় অংক শিখতে হবে। একেবারে শুরু থেকেই সব শিখাতে হচ্ছে ও হবে। খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম আমি। বার্ষিক পরীক্ষাও এসে যাচ্ছে সামনে! এ চিন্তা আমার সে-মুহূর্তের নয়, এ চিন্তা প্রথম থেকেই আমার মাথায় ঢুকে রয়েছে। কী করি, কী করি? কীভাবে সব কটা অংক করানো যায়? ভাবছি আর ভাবছি! ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে একটা গল্প ফেঁদে নিলাম। অংকের খাতাটা আমার হাতের নিচে রেখে, রাসেলকে প্রশ্ন করলাম-
: তোমার স্কুলে কোনো বন্ধু আছে?
: ভ্রু কুঁচকে উত্তর দিল, আছে। ক্যান?
: তুমি তাদের সাথে কী কর?
: ক্যান? খেলি, গল্প করি। আরও অনেকে কিছু করি।
: ও। তুমি চকলেট খুব পছন্দ কর, তাই না?
: হ্যাঁ। এই কথা জিজ্ঞাসা করতেছেন ক্যান?
: স্কুলে চকলেট নিয়ে যাও?
: হ্যাঁ, যাই তো চকলেট নিয়া।
ও কিন্তু ভ্রু যুগল কুঁচকেই উত্তরগুলো দিয়ে যাচ্ছে।
: তুমি স্কুলে চকলেট নিয়ে যাও তাহলে?
: স্কুলে চকলেট নেই তো।
: কোথায় পাও চকলেট? মানে কোথা থেকে নিয়ে যাও চকলেট?
: ক্যান, বাসার থিকা নিয়া যাই।
: বাসা থেকে কি একটা চকলেটই নিয়ে যাও?
মাথা নেড়ে বেশ বিরক্ত হয়ে বললÑ
: না একটা চকলেট নেব ক্যান? অনেকগুলি নিয়া যাই।
: তুমি তোমার বন্ধুদের সামনেই চকলেটগুলো খাও?
: হ্যাঁ বলে, আমার দিকে তাকিয়ে থাকল।
: বন্ধুদের দাও না? একা একা সব চকলেট ওদের সামনেই খাও?
এবার আমার বুঁচু গর্জে উঠে বলে-
: আপনি কিচ্ছু জানেন না। আমি ক্লাসের সবাইকে আগে দিয়া তারপর খাই। কোনোদিন আমার জন্য একটাও থাকে না।
: আমি ততোধিক শান্তভাবে বললাম, ও! তুমি তাহলে সকলকে দাও চকলেট?
: আমি সবাইকে দিয়া খাই।
ঠিক এই সময়ে আমি আস্তে করে আমার হাতের তলা থেকে অংকের খাতাটা বের করে ওকে বললামÑ
: দেখো, পাঁচটা অংকের মধ্যে তুমি তিনটে করেছো, দুটোকে করোনি, ঐ দুটো অংক কষ্ট পেল না? ওরা মনে মনে কষ্ট পেয়ে ভাবছে, রাসেল ভাই তিনজনকে (তিনটে অংক) করলো, আমরা দুজন বাদ পড়ে গেলাম। আমাদের দুজনকে করলো না! ঐ অংক দুটো তো কষ্ট পেল! এখন বলো, আমি কীভাবে বুঝবো তুমি তোমার বন্ধুদের চকলেট দাও?
ছোট্ট মানুষ! আমার মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে বলে উঠল-
: অংক কি বুঝতে পারে? অংকের কি প্রাণ আছে? ওরা কি কথা বলতে পারে? ওদের তো প্রাণ নাই, তাইলে ওরা কষ্ট পাবে ক্যান?
: তুমি ঠিক বলেছো। ওরা আমাদের মতো কথা বলতে পারে না ঠিক, কিন্তু ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে পারে। মানে, অংকে অংকে কথা বলতে পারে। দেখো না, একটা পিঁপড়া আর একটা পিঁপড়ার গা ছুঁয়ে যায়, এভাবেই ওরা কথা বলে। ওটাই ওদের কথা বলার ভঙ্গি।
একটু যেন চিন্তায় পড়ে গেল আমার ছোট্ট ছাত্রটি। বলে উঠল-
: এইটা ক্যামনে হয়?
: বারে, হবে না কেন? আমাদের যেমন ‘বাংলাদেশ’ আছে, অংকেরও হয়তোবা একটা ‘অংকের দেশ’ আছে। ওরাও আনন্দ পায়, কষ্ট পায়, দুঃখ পায়।
কথাগুলো শেষ করার সাথে সাথে সে বলল-
: দ্যান, খাতাটা দ্যান।
হাতের তলা থেকে খাতাটা ওর দিকে ঠেলে দিলাম। টান মেরে খাতাটা নিয়ে ঝট্পট্ অংক দুটো করে খাতাটা আমার দিকে ঠেলে দিয়ে বলল-
: ন্যান আপনার অংক। এখন তো ওদের কষ্ট হবে না।
সব ক’টা অংক সেদিন সে ঠিকভাবে করেছিল। কত মায়া-মমতায় ভরা ওই ছোট্ট বুকখানি। আমার ছলনায় সে নিজে কষ্ট পেয়ে, অংক দুটোর কষ্ট অনায়াসে মুছে দিল।
এমন আর একটা ব্যাপার পরের দিন ঘটেছিল। সেদিন সব বিষয় পড়ানো হয়ে গেছে, এবার অংকের পালা। আর আমার পালা হচ্ছে কীভাবে ওকে অংক করার কথা বলা যায়! আমি চেয়ার থেকে নিজেকে একটু নাড়া দিয়ে টেনে টেনে বললাম-
: এ-বা-র আমাদের অ-ঙ্কের পালা।
খেয়াল করলাম ওর মুখের অভিব্যক্তি। না, কোনো অনীহার প্রকাশ ঘটল না। আমি নিশ্চিত হয়ে ওর খাতাটা নিলাম। খাতাটা নেবার সাথে সাথে রাসেলের জিজ্ঞাসা-
: আইজ আমারে কয়টা অংক দেবেন?
: দেখি ক’টা দেই! তুমি ক’টা করতে চাও?
কোনো উত্তর নেই। একেবারে চুপ। আমি ছয়টা কি সাতটা অংক লিখে ওর দিকে খাতাটা এগিয়ে দিয়ে বললামÑ
: মন দিয়ে দেখ তারপর অংকগুলি কর, সব ক’টাই পারবে।
আমার কথা শুনে ওর ভ্রু দুটো একটু কুঁচকে গেল।
বুঝলাম, পছন্দ হয়নি। বেশ তাড়াতাড়ি আমাকে খাতাটা ফেরত দিল। আমি খুশিমনে খাতাটা টেনে নিলাম। ওমা! খাতাটার দিকে তাকিয়ে দেখি আজও সে সবগুলো অংক করে নাই। এ অবস্থা দেখে আমি বললামÑ
: এ কি! সবগুলো অংক করোনি কেন?
উদাসমনে উত্তর দিল-
: না, আর করবো না।
: কেন?
: ভালো লাগে না। রোজ রোজ অংক করতে ইচ্ছা করে না।
একটু অনুরোধের সুরেই বললাম-
: করে ফেলো না! মাত্র তো দু-তিনটে আছে!
: বললাম তো ভালো লাগে না।
এ-কথা বলেই সে খাতার পাতাটা ছিঁড়ে ফেলে দিল এবং পাতাটাকে আরও দু-টুকরো করে ছিঁড়ে ছোট্ট হাতে দলামোচা করে মেঝেতে ফেলে দিল। আমার তখনকার অবস্থা বা অনুভূতির কথা নাইবা বললাম!
আমি চুপচাপ! টেবিলের উপর আমার হাত দুটো অসহায়ের মতো ফেলে রেখে বসে থাকলাম।
রাসেল বলে উঠল-
: আমারে বকবেন এখন? বকেন!
আমি মাথা নেড়ে বুঝালাম, না বকবো না। এ সময় ফরিদ (কাজের ছেলে) চা-জলখাবার নিয়ে ঢুকলো।
টেবিলের উপর ট্রেটা রেখে, কাগজের ছেঁড়া টুকরোগুলো দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলোÑ
: আপা, এগুলো কী?
আমি কিছু বলার আগেই রাসেল বলে উঠল-
: আমি খাতা ছিঁড়ছি।
: ভাইয়া, আপনি (ওরা রাসেলকে তুমি না আপনি বলতো আজ মনে নেই। তাই আপনি লিখছি) খাতা ছিঁড়ছেন? ক্যান?
ভাইয়ার উত্তরÑ
: আমার ইচ্ছা।
আমি একদমই চুপ। আমার দিকে তাকিয়ে রাসেল মিট্মিট্ করে হাসছে। মনে মনে হয়তোবা ভাবছে, আমি ওকে বকছি না ক্যান? সে হয়তো আশা করেছিল, আমি রাগ করে ওকে বকবো বা কিছু বলবো। ফরিদ চা দিয়ে চলে যাবার সময় মেঝেতে পড়ে থাকা ছেঁড়া কাগজের টুকরোগুলো উঠিয়ে টেবিলের উপর রেখে চলে গেল। ফরিদ চলে যাবার পর, আমি দেখি, রাসেল ছেঁড়া কাগজের টুকরোগুলো আস্তে আস্তে খুলতে শুরু করলো। হঠাৎ করে বলে উঠল-
: আপা, দ্যাখেন অংকগুলি ছেঁড়ে নাই! পাস দিয়া ছিঁড়ছে। অংকগুলি আস্থা আছে। ওরা (অংকগুলি) যদি দুই টুকরা হইয়া ছিঁড়া যাইতো, তবে তো ওরা ব্যথা পাইতো, তাই না আপা?
বুঝতে আমার আর বাকি থাকলো না, গতকালের রেশ ঐ ছোট্ট বুকখানাতে বাসা বেঁধে ফেলেছে। আমিও মাথা নেড়ে সায় দিলাম ওর মানবতাবোধের সাথে।
এই শিশু ভোলানাথকে ভালো না বেসে পারা যায় কি? ওর অবুঝ মনটা কত সহজ সরল! ছোট্ট হৃদয়খানা মায়া আর মমতায় মাখা! তা না হলে ঐ অংকগুলোর জন্য এতটা কষ্ট পায়? অথচ, যারা আমার এই সুন্দর বুঁচু সোনার ছোট্ট মায়াভরা বুকটায় বুলেট ভরে দিল, তাদের কি একটুও কষ্ট হলো না?
তাদের সন্তানদের মুখ একবারও মনে পড়লো না? মনে হলো না, তাদের সন্তানদের যদি এমনভাবে বুলেটে বুক কেউ ঝাঁঝরা করে দেয়! তখন তার কেমন লাগবে?
ঈশ্বর কি এই খুনিদের কখনো ক্ষমা করবেন? তাই তো ঈশ্বরের কাছে প্রশ্ন আমার, “তুমি কি তাদের করিয়াছ ক্ষমা, তুমি কি বেসেছ ভালো?”
ওই ক’দিনেই রাসেলকে আমি অনেকখানি ভালোবেসে ফেলেছিলাম। সারাদিন কাটতো আমার ওকে ভেবে।
কীভাবে ওকে পড়ানো যায়, কী করব পরের দিনগুলো, ইত্যাদি ইত্যাদি! রাসেলও আমাকে মনে হয় একটু একটু পছন্দ করা শুরু করেছে। সেটা আমি ওর আচরণে টের পেতে শুরু করেছি। ক’দিন যাবত দেখছি, সে আমার ফেরার সময় সিঁড়ি পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়ে থাকছে। আমি গাড়িতে উঠলে সে ভেতরে চলে যাচ্ছে। এটাও আমি খেয়াল করেছিলাম। মুন্সী ভাইয়ের কাছে শুনলাম, সে এখন বই নিয়ে বসে। তবে পাশাপাশি মুন্সী ভাই আরও বলতো-
: দ্যাখেন, কয়দিন থাকে এই রকম! থাকলে তো ভালো।
: মুন্সী ভাই, আমাকে চেষ্টা করে যেতে হবে।
: তা ঠিক। আপনি তো চেষ্টা করতেছেন আপা।
তখনো মাস পুরোয়নি। রাসেল উষসীর আবছা আঁধার থেকে আমাকে একটু একটু করে ভোরের আলোয় পৌঁছে দিচ্ছে। সে অজানা অচেনা পড়াগুলো শিখতে শুরু করেছে এবং শিখে যাচ্ছে। লয়টা খুব দ্রুত না হলেও মন্দ নয়! আমি যেন ওর কথা বলার, গল্প করার সঙ্গী হয়ে উঠছি। এখন টেবিলে পড়তে এসে জিজ্ঞেস করে-
: আপা ভালো আছেন? কীভাবে আসছেন? গেটে আপনারে আটকাইছে? ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রশ্নের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বাসায় সে কি পড়েছে তাও বলছে। এ-সময়টা বেশ লাগতো। আমার মনের ভয়টাও একটু একটু করে কমতে শুরু করেছে। ওকে পড়াতে পারব এ বিশ্বাসটুকু মনের মধ্যে অনুভব করলাম। রাসেলকে পড়ানো ছিল আমার কাছে এক কঠিন তপস্যা। এ তপস্যায় আমায় সফল হতে হলে, ওকে এবং ওর ইচ্ছেগুলোকে প্রাধান্য দিতে হবে। এটা বুঝলাম। এখন মুন্সী ভাইয়ের কথাও কমে গেছে। মুন্সী ভাই এখন বলে-
: পড়ায় রাসেল ভাইয়ার মন বসছে মনে হয়। আপনি কি কন আপা?
: রাসেল আগের টিচারদের সাথে কি করতো অথবা তারাই বা কি করতেন, আমি তো জানি না। আমি তো ওকে মাত্র ঘণ্টা দেড়েক বা দু-ঘণ্টার মতো পড়াই, অন্য সময় বাসায় থাকে। এ সময় যদি রাসেল একটুখানিও পড়ে, তবে আমার চিন্তা নাই। ও খুব সুন্দর মনে রাখতে পারে, কিন্তু ও বাসায় বই নিয়ে বসে কি না সেটাই কথা! মুন্সী ভাই হেসে বলল-
: এখন তো ভাইয়া রোজই বই নিয়া বসে, আগে তো বসতোই না।
রাসেলের শিশুকালটাও এই মুন্সী ভাই-এর কাছ থেকেই আমার শোনা। সে-কথাগুলো আজ নয়, সুযোগ এলে অন্য সময় বলবো। সুযোগের অপেক্ষায় থাকলাম।
আজ প্রায় পড়ানোর পঁচিশ-ছাব্বিশ দিন চলে গেল, ঐ বাসার কাউকেই আমি দেখতে পাইনি।
ফুল পছন্দ বলে, মালীকে রাসেল ফুল দিতে বলেছিল। সেও আরেক গল্প! সেই মালীকে একটু সময়ের জন্য দেখেছি। মোটকথা, এ ক’দিন আমি তিনজনকে কাছ থেকে দেখেছি। সে হলো, রাসেল, ফরিদ আর মুন্সী ভাই।
হঠাৎ করেই এই মুহুর্তে মনে হয়ে গেল আর এক ঘটনা। ঘটনাটা মজার বলেই ইচ্ছে হলো লেখার।
এ ঘটনার জন্মলগ্ন তৃতীয় বা চতুর্থ দিনে। আজ প্রধান গেটে কেউ আমার জন্য অপেক্ষায় নেই। গেটের পুলিশকে পরিচয় দিতেই আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিল। গণভবনে ঢোকার পথটা মনে ছিল। দোতলায় ওঠার সিঁড়িতে ড্রাইভার মুন্সী ভাই-এর সাথে দেখা।
সে-ই আমায় ওপরে নিয়ে এসে ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে চলে গেল। বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর রাসেল এলো। বই এর ব্যাগটা টানতে টানতে অনেকটা ছ্যাছরানোর মতো করেই ডাইনিং টেবিলের ওপরে রেখে দিল। এবার আমার পাশের চেয়ারটাতে সে বসলো।
বসেই আমাকে প্রশ্ন করলÑ
: আইজ এত তাড়াতাড়ি আসছেন ক্যান?
: এ সময়ই তো আমার আসার কথা। তাই না?
আমার তখন হাতের ঘড়ি ছিল না। তাই সময়টা বুঝতে পারিনি।
: মা বলল, আপনি একটু আগে আসছেন। আমি ঘুমে ছিলাম। মা ঘুম থিকা ডাকলো আপনি আসছেন বলে।
বুঝলাম নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটায় মুড অফ হয়ে আছে। তাই বলে ফেলি-
: দু-একদিন এদিক-সেদিক হতে পারে।
খুব খুশি হয়েছে বলে মনে হলো না। পড়ার কথা বলে ব্যাগটা খুলতে বললাম। ব্যাগটা সে আমার দিকে ঠেলে দিয়ে বললÑ
: আপনি খোলেন।
ঘুমের আমেজ তখনও তার চোখ থেকে যায় নাই। টেবিলের ওপর বাঁ হাতের কনুই রেখে, তার ওপরে মাথা কাত করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। নিরুপায় হয়ে আমি-ই ব্যাগটা খুলে বইগুলো বের করে নিলাম। বইগুলো বের করে আমি ওর মাথায় হাত বুলাতেই, চট্ করে মাথাটা সরিয়ে নিল। আমি একটু অবাক হলাম। বললামÑ
: রাসেল মাথা উঠিয়ে ঠিক হয়ে বসো। কাল যে পড়া দিয়ে গেছি সেগুলো কি শিখেছো?
কোনো উত্তর দিল না। ঐভাবেই মাথাটা রেখে বিরক্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
: কালকের পড়া তোমার কি হয়েছে? আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম।
: হুৃঁ হইছে।
: তবে পড়া শুরু করি?
: করেন।
আজ ‘অ আ ক খ’-এর উল্টোপাল্টা লেখা ছিল। যাকে আমরা ‘ধরা’ বলে থাকি। মাথাটা যেভাবে কাত করা ছিল সেভাবেই রেখে লিখতে শুরু করল। যেটা লিখতে পারছে না, অর্থাৎ ভুল করছে, সে তখনই বলে উঠছেÑ
: কঠিনটা দ্যান ক্যান?
কথা শুনে আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছি না।
হাসি চেপে ওকে লিখতে বলে যাচ্ছি। ও আমার ঠোঁটে হাসির আভাস দেখে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলÑ
: হাসছেন ক্যান? পারি না, তাই?
: তাড়াতাড়ি উত্তর দিলাম, না না! তোমার চোখে এখনও যে ঘুম লেগে আছে, তাই দেখে আমার হাসি পাচ্ছে।
: ও!
কত সহজে মিথ্যা বলে ওকে বুঝিয়ে দিতে পারলাম।
রাসেল আমার কথা সত্যি ভেবে উত্তর দিল ‘ও।’
ও যে শিশু এতেই তো বোঝা যায়।
এমনি অনেক অনেক কথা রয়েছে, যা আমার সাথে রাসেল করতো। ওর বুকখানা ছিল মায়া-মমতায় ভরা। ওর ভেতরে আমার জন্য ছিল এক অনাবিল ও অনামিক কি এক অদ্ভুত অনুভূতি। ওর সকল চিন্তা-চেতনার ভাগাভাগি হতো আমার সাথে।
ঘরের-বাইরের কথাগুলোও আমাকে না বললেই নয়। এই সাথে সতর্কতাও থাকতো এমন, “আপা, কাউকে এ-কথা বলবেন না কিন্তু।”
আমার প্রতি ছিল প্রখর দৃষ্টি। আমি কি খেতে পছন্দ করি না করি এটা ছিল ওর নিত্যদিনের রুটিন। আমি যা ভালো খাই, বাসায় সে জিনিস এলে আমার জন্য রেখে দিতে বলতো। শুধুমাত্র তা নয়, আমি গেলে আমার পছন্দের সেই খাবার দেওয়া হলো কি না সেটা সে দারুণভাবে খেয়াল করতো। যদি দৈবাৎ কখনও ভুল হয় তাহলে বাড়িতে কুরুক্ষেত্র ঘটে যেত। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা বলছি :
এমনি একদিন রেহানার ঘরে রাসেলকে পড়াচ্ছি। পড়ার মাঝখানে রোজ চা-জলখাবার দিয়ে যেত রমা বা ফরিদ। এরা দুজনই বেশিরভাগ সময় চা-খাবারটা দিয়ে যেত। চায়ের সাথে যেদিন মিষ্টি থাকত, সেদিন আমি শুধু চা-টাই খেতাম। মাঝে মাঝে হয়তো বা একটা মিষ্টি খেয়ে নিতাম। কেননা আমি মিষ্টি পছন্দ করি না। আজও তাই। আমার এই মিষ্টি না খাওয়াটা রাসেল যে খেয়াল রাখতো, তা আমি স্বপ্নেও চিন্তা করি নাই। সেদিন রমা চা আর দুটো মিষ্টি দিয়ে গেছে। আমি যথারীতি শুধু চা-টাই খেলাম, মিষ্টি খাই নাই। হঠাৎ পড়তে পড়তে রাসেল আমাকে জিজ্ঞেস করলো=
: আপা, আপনি একদিনও মিষ্টি খান না কেন?
: ক্যানো, খাইতো।
: মাঝে মাঝে খান। রোজ মিষ্টি খান না কেন? এ-কথা বলে, আমার জবাবের অপেক্ষায় আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
ও যখন সিরিয়াস হয়ে যেত, তখন ভ্রু যুগল কুঁচকে নিয়ে কথা বলতো। এটা বন্ধ করার চেষ্টা ছিল আমার। আমি দু-আঙ্গুল দিয়ে ভ্রু দুটো টেনে দু-পাশে নিতাম। এটাও ও বারবার করতো আমাকে চটাবার জন্য। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললামÑ
: আমি মিষ্টি পছন্দ করি না যে, তাই খাই না।
ব্যাস, এ-কথা বলে আমি নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারলাম! সঙ্গে সঙ্গে আমার বুঁচুর (এ নামটা আমার বুঁচুর খুব পছন্দ ছিল এবং আমার বড় আদরের নাম) উত্তরÑ
: আমিও তো পড়তে পছন্দ করি না, তবে আমারে রোজ রোজ পড়ান ক্যান?
: আরে কি মুশকিল! তোমার পড়ার সঙ্গে আমার মিষ্টি খাওয়ার কি সম্পর্ক?
: ওর দু-ঠোঁটে দুষ্টুমির মিষ্টি হাসি। হাতের কাঠপেন্সিলটা দু-আঙ্গুলের ফাঁকে, সেটা ডানে বায়ে দুলিয়ে দুলিয়ে বলল, সম্পর্ক আছে আছে। মুখে মিষ্টি দুষ্টের হাসি আর মাথায় দুষ্ট বুদ্ধির অনুশীলন চলছে।
এর মধ্যে রমা শূন্য খাবারের প্লেট, চায়ের কাপ নিতে এসেছে। চায়ের কাপটা নিয়ে ওর হাতের ট্রেতে রেখে, মিষ্টির প্লেটটা নেবে বলে হাত বাড়িয়েছে।
রাসেল রমাকে মিষ্টির প্লেটটা নিতে মানা করলো। বেচারা রমা চুপ্ করে থেমে গেল। রমাকে রাসেল বলল,
: আপা মিষ্টি খাবে, তুই মিষ্টি নিবি না।
: আমি খাব না মিষ্টি। রমা, তুমি মিষ্টিটা নিয়ে যাও।
: না রমা, নিবি না। আপনাকে আইজ মিষ্টি খাইতে হবে।
এবার রমা কথা বলে উঠলÑ
: আপা, ভাইয়া যখন বলতেছে, আইজ খান।
: তুই যা রমা। রমা চলে গেল বটে, কিন্তু মিষ্টির প্লেটটা যথাস্থানেই রয়ে গেল।
এবার রাসেল আমার দিকে ফিরে তার বক্তব্য শুরু করল-
: আপনি মিষ্টি পছন্দ করেন না বলে মিষ্টি খান না, আমিও তো পড়তে পছন্দ করি না, তবে আমিও পড়ব না। এ-কথা বলেই, হাতের কাঠপেন্সিলটা টেবিলের উপর রেখে বইখানা বন্ধ করে দিল।
বললাম-
: আমার মিষ্টি খেতে কষ্ট হয়, তাই খাই না।
: আমারো পড়তে কষ্ট হয়, তাই পড়বো না।
: উঃ কি যে যন্ত্রণায় পড়লাম আমি!
রমা এ-ঘর থেকে বেরিয়ে বাসার সকলকে এ মিষ্টির কাহিনি বলে দিয়েছে। খবরটি পেয়ে কাকীমা (রাসেলের মা শ্রদ্ধেয়া ফজিলাতুন্নেছা) আমাদের কাছে এসে গেলেন। হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেনÑ
: কী হইছে তোদের?
আমি কিছু বলার আগেই রাসেল বলে উঠল-
: আপা একদিনও মিষ্টি খায় না। মিষ্টি পছন্দ করে না, তাই খায় না। আমিও বলছি, আমিও তো পড়তে পছন্দ করি না, তাইলে আমাকে পড়ান ক্যান? আমিও আর পড়বো না। ব্যাস!
আমি তখন কাকিমার মুখেও দুষ্টামির হাসি দেখতে পাই। আমার দিকে তাকিয়ে কাকীমা বললেনÑ
: রাসেল যখন কইছে, নে একটা মিষ্টি খা।
: না না, আপার দুইটাই খাইতে হবে। তা না হইলে তো আমি পড়বো না।
অগত্যা, আমাকে দুটো মিষ্টিই খেতে হয়েছিল।
: আপা রোজ আগে মিষ্টি খাবে, তারপর আমি পড়া শুরু করবো। আপনাকে যে কয়টা মিষ্টি দেবে, সব কয়টা মিষ্টিই আপনার খাইতে হবে।
আমি অসহায় চোখে কাকীমার দিকে তাকিয়ে। কাকীমাও মজা পাচ্ছিলেন। শেষে আমার গুরুদ-, লঘুদণ্ডে পরিবর্তন করে কাকীমা বললেন
: ঠিক আছে, এখন থিকা গীতালি তুই রোজ দুইটা কইরা মিষ্টি খাবি, তারপর রাসেল পড়বে।
এই মিষ্টির ঘটনা নিয়ে বাসার সবাই আমাদের সাথে মজা করতো। এমনকি এ শাস্তির আনন্দের ভাগ থেকে কাজের লোকেরাও বাদ পড়ে নাই।
পড়ার সময় রাসেল বারেবারে ‘আপু, আপু, আপু’ করতে থাকত। আমি বলতাম-
: এতবার ‘আপু, আপু’ করো কেন?
দুষ্টুমিভরা হাসিখানি আমার দিকে ছুড়ে দিয়ে, আবার ডাকতো-
: আপু, আপু
: ওরে বাবারে! এতবার কেউ ডাকে?
আবার হাসতো। বুঝতে পারতাম আমাকে খেপানো হচ্ছে। ও যে কবে কখন ‘আপা’ ডাকা ছেড়ে ‘আপু’ ডাকতে শুরু করেছিল, তা আমি টেরও পাইনি! দুজন অসম বয়সের ছাত্র-শিক্ষকের গভীর বন্ধুত্ব যে কোন্ মাহেন্দ্রক্ষণ থেকে শুরু হয়েছিল জানতেও পারিনি।
আমাদের দুজনের মধ্যে মান-অভিমান, কথা কাটাকাটি, তর্ক, হাসি-আনন্দ, গল্প, খেলা, দুষ্টুমি স-ব সব-ই চলতো! সেইসব, কার ইশারায় এক ফুৎকারে নিবে গেল! বুঁচু সোনার ঐ ‘আপু আপু’ ডাক, আজও আমার কানে বাজে। বুঁচুর জ্বলজ্বলে কালো চোখ দুটো দুষ্টুমির হাসি হেসে, আমায় বলে যাচ্ছে-

“তোমারি নাম বলব না না ছলে,
বিনা প্রয়োজনের ডাকে ডাকব তোমার নাম,
সেই ডাকে মোর শুধু শুধুই পূরবে মনস্কাম।”
এ ডাক আমি আজও শুনতে পাই, চোখ বুজে অনুভব করি আর ভাবি, “শিশু যেমন মাকে নামের নেশায় ডাকে, বলতে পারে এই সুখেতেই মায়ের নাম সে বলে।”
বুঁচু, আমি একান্তে নিভৃত অরে আজও শুনতে পাচ্ছি, তোমার ‘আপু আপু’ ডাক! তোমায় অনেক অনেক ভালোবাসি!! বুঁচু সোনা, আজও আমি তোমার সেই প্রিয় গান শুনে যাচ্ছি-

লেখক : ১৯৭২ থেকে ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ পর্যন্ত রাসেলের গৃহশিক্ষিকা; তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। পরে অধ্যাপনা করে অবসর নিয়েছেন। এখন সিডনি প্রবাসী।

সর্বশেষ নিবন্ধ

ফেসবুকে সারথি

শেয়ার করুন