তোমার জন্য অসীম ভালোবাসা

শেখ রাসেল। মাত্র ১০ বছর ১০ মাসের জীবন তার। জন্ম ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল। ছোট্ট এক জীবনের মধ্য দিয়ে বাঙালির স্বপ্নকে আপন করতে শিখেছিল মাত্র। দুই চোখ মেলে দেখতে চেয়েছিল পৃথিবীর অপার সৌন্দর্য।

রাসেলের জন্ম মুহূর্তটি এক উজ্জ্বল আলোয় ভরে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে। ওই সময়টা ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। বাড়িতে এসেছেন ডাক্তার, নার্স। নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার জন্য সেদিন অধীর অপেক্ষা নিয়ে ঘুম ঘুম চোখে জেগে ছিলেন ভাইবোনরা। মেজফুপু এসে খবর দিলেন, ভাই হয়েছে। খুশিতে সবাই আত্মহারা। বড় ফুপু ফুটফুটে চাঁদের কণা প্রথম তুলে দিলেন শিশুর বড় আপুর কোলে। মাথাভরা ঘন কালো চুল। তুলতুলে নরম গাল। পৃথিবীর বুকে জন্ম নেওয়া নতুন শিশুর নাম রাখা হলো শেখ রাসেল।

জন্মের পর থেকেই বাবার সঙ্গে শেখ রাসেলের দেখা হতো কম। কারণ বাবার বেশিরভাগ সময় কেটেছে কারাগারে। মা ও বড় ভাইবোনদের কোলে চড়েই কেটেছে শৈশবের দুরন্তপনা মুহূর্তগুলো। রাজনৈতিক পরিবেশ ও নানা সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছে শেখ রাসেলকে।

দীর্ঘ ইতিহাসের পথপরিক্রমায় কত সংগ্রাম, কত রক্তস্রোত, কত বেদনা, জেল-জুলুম, অত্যাচার, নিপীড়ন সইতে সইতে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে রচিত হলো এ দেশের বিজয়। বিজয়ের এই গৌরব আপামর জনতার সঙ্গে শিশুরাও অনুভব করছে। বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে যে সাহস আর সংগ্রামের ঝাঁঝাল প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছে, সেখানে এ দেশের শিশুরাও গৌরবের প্রতীক হয়ে মিশে আছে। শিশুদের প্রতীক শেখ রাসেল।

বাংলাদেশ শিশু একাডেমি প্রকাশিত ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ গ্রন্থে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লেখেন- ‘আব্বা যখন ৬ দফা দিলেন, তার পরই তিনি গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন। রাসেলের মুখে হাসিও মুছে গেল। সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে রাসেল আব্বাকে খুঁজত। রাসেল যখন কেবল হাঁটতে শিখেছে, আধো আধো কথা বলতে শিখেছে, আব্বা তখনই বন্দি হয়ে গেলেন। মা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আব্বার মামলা-মোকদ্দমা সামলাতে, পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। সংগঠনকে সক্রিয় রেখে আন্দোলন-সংগ্রাম চালাতেও সময় দিতে হতো।’

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা তার ছোট ভাই সম্পর্কে লেখেন- শেখ রাসেল আমাদের ভালোবাসা। তার একটি লেখা থেকে উদ্ধৃত করা যেতে পারে- ‘আব্বার সঙ্গে আমার ও রাসেলের জাপান, মস্কো ও লন্ডন বেড়ানোর সুযোগ হয়। রাষ্ট্রীয় সফর বলেই রাসেল বিদেশিদের সাথে খুব সৌজন্যমূলক ব্যবহার করত। সে ছোট্ট হলেও বুঝতে পারত কোথায় কীভাবে চলতে, শিখতে হবে। ঢাকায় ফিরে আমি যখন মা ও সবার কাছে ওর এই সুন্দর ব্যবহারের গল্প করেছি, তখন সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনেছে। লন্ডনে বিখ্যাত মাদাম তুসোর মিউজিয়ামে আমরা যখন বেড়াতে যাই, রাসেলের বিস্ময় আর কাটে না। আমরা দুইজন আব্বার সাথে নাটোরের উত্তরা গণভবনেও গিয়েছি। রাসেল সেখানে মাছ ধরত, আমরা বাগানে ঘুরে বেড়াতাম। ঢাকার গণভবনেও রাসেল মাছদের খাবার খাওয়াত। ফুপাতো ভাই আরিফ তার খুব ভালো ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। তারা দুইজন একই স্কুলে পড়ত এবং একসঙ্গে খেলত। টুঙ্গিপাড়ায় তাদের একটা ক্ষুদে বাহিনী ছিল- যাদের সঙ্গে খালের পানিতে সাঁতার কাটা, ফুটবল খেলায় মেতে থাকত তারা।’

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দীর্ঘ ৯ মাস মা ও বড় বোনদের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে শেখ রাসেলকে বন্দিজীবন কাটাতে হয়। বড় ভাই শেখ কামাল, শেখ জামাল তখন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। গৌরবমাখা বিজয়ের আনন্দমাখা অনুভূতি নিয়ে তারা মুক্ত হন ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১।

শেখ রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তরে ঘুরেছেন। মানুষের দুর্দশার সঙ্গী হয়েছেন। শেখ রাসেলকে বঙ্গবন্ধু শুনিয়েছেন দেশের কথা, স্বপ্নের কথা। নিজের কনিষ্ঠ পুত্র বলে নয়, শেখ রাসেলকে সঙ্গী করে বঙ্গবন্ধু কার্যত শিশুর জন্য জগৎ তৈরি করে দিতে চেয়েছেন। রাসেলের মধ্য দিয়ে এ দেশের শিশুদের সঙ্গে ‘ভালো’র পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।

বাবার বুকের গভীরে মুখ রেখে সাহস আর বীরত্বের অনুভব করেছিল শেখ রাসেল। তারও স্বপ্ন ছিল বড় হওয়ার। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র শেখ রাসেলের ইচ্ছা ছিল শৈশবের দুরন্তপনায় উড়ে বেড়াতে, ঘুরে বেড়াতে। কিন্তু নরপিশাচদের বুলেটের আঘাত শেখ রাসেলের স্বপ্নময় জীবনটাকে স্তব্ধ করে দিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। মা-বাবা, ভাই-ভাবিদের রক্তের সঙ্গে মিশেছে তার নিথর দেহ। মায়ের কাছে যেতে চেয়েছিল রাসেল। মায়ের রক্তাক্ত লাশ দেখে আকুতিভরা কণ্ঠে শেখ রাসেল বলেছিল, ‘আমাকে আমার হাসু আপার কাছে পাঠিয়ে দিন।’

নরপিশাচ ঘাতকের দল- ওরা দেয়নি। শেখ রাসেলের কথা শোনেনি। তাকে বাঁচতে দেয়নি।
বাঙালি ইতিহাসের ওই নৃশংসতম রাতে বুলেটের আঘাতে ঝরে গেল বাগানের নিষ্পাপ কুঁড়ি। আমরা কেমন করে ভুলি শেখ রাসেলকে।

এই বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, লাল-সবুজের পতাকাসহ যেখানে-যেখানে ছড়িয়ে আছে বীর বাঙালির ইতিহাস- সেখানেই শেখ রাসেল।
শেখ রাসেল, আমাদের কাছে আজ শোকগাঁথার এক কবিতার ভুবন।

লেখক: শিশুসাহিত্যিক

সর্বশেষ নিবন্ধ

ফেসবুকে সারথি

শেয়ার করুন